শূন্য থেকে কোটিপতি মাসুম
জামালপুর সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
ফাইল ফটো
ছয় বছর আগেও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করতেন। সংসারে অভাব ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে অবৈধ পথের আয় দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বনে গেছেন কোটিপতি। গড়েছেন অঢেল সম্পদ, রয়েছে একাধিক সুপার শপ, জমিসহ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বাড়ি। নিয়মিত ঘুরতে যান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। দীর্ঘ সময়ে তার এই অবৈধ উপার্জন এখন বৈধ আয় হিসেবে দেখাচ্ছেন তিনি।
আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এই ব্যক্তির নাম মাহমুদুল হাসান (৩৮)। বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার আদিপৈত গ্রামে। এলাকাবাসী তাকে ক্যাসিনো মাসুম হিসেবে চেনে।
জানা যায়, ২০১৮ সালে মেলান্দহের জিন্নাহ মার্কেটের নিচতলায় মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান দেন মাসুম। একপর্যায়ে সেই দোকানে শতকরা ২০ টাকা হারে জুয়ার আসর বসান। সেখান থেকেই জুয়ার দুনিয়ায় প্রবেশ মাসুমের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিন্নাহ মার্কেটের এক দোকানদার বলেন, মার্কেটের নিচতলায় মাসুম যখন জুয়ার আসর শুরু করল। তখন দিন-রাত জুয়া চলত। দোকানে অনেক লোকজন থাকত। বিষয়টি নিয়ে কানাকানি শুরু হলে তিনি ছাদে একটি ক্যাফে দেন। সেটার আড়ালে রমরমা জুয়া চালাতেন। কত মানুষ যে জুয়া খেলে নিঃস্ব হয়েছে তার হিসেব নেই।
মাসুমের সঙ্গে জুয়া খেলায় অংশগ্রহণকারী একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটা সময় মাসুমের কাছে রিকশা ভাড়ার টাকাটা পর্যন্ত থাকত না। পরে তিনি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে জুয়ার আসর বসান। এভাবে কিছু দিন চলার পর নিজে একটা জুয়ার অ্যাপস বানান। কারণ আইটি বিষয়ে তিনি খুবই দক্ষ ছিলেন। ২০১৯ সালে দেশের বাইরে গিয়ে অ্যপসটি আপডেট করিয়ে আনেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন তিনি কয়েকটি অ্যাপসের সুপার এজেন্ট।
২০১৯ সালে সারা দেশে যখন ক্যাসিনো কাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হতে থাকে। তখন র্যাবের হাতে আটক হন মাসুম। তবে সেই মামলায় খালাস পেয়ে যান। পরে আরও একবার র্যাবের হাতে ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে যান।
মাসুমের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, মাসুমের মোবাইলে একটি অ্যাপস আছে যেটিতে ক্লিক করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলের সব ডাটা রিমুভ হয়ে যায়। মাসুম যতবার বিপদে পড়েছে বা কোনো বিপদের সংকেত পেয়েছে। তখনই তার মোবাইলের সব ডাটা রিমুভ করে ফেলেছে।
মাসুমের যত সম্পদ
মাসুম তার অবৈধ আয় থেকে ২০২০ সালে মেলান্দহের ব্র্যাক মোড়ে দুই বিঘা জমি কিনেছেন। যেখানে রয়েছে তার মিশাল এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। জামালপুর-মেলান্দহ সড়কের শিমুলতলা এলাকায় বড় একটি জমি রয়েছে মাসুমের। এর কিছু অংশে মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন তিনি। যার দাম কোটি টাকার বেশি। এছাড়া জামালপুর শহরের পশ্চিম নয়াপাড়া এলাকায় একজন চিকিৎসকের বাড়ি কেনার কথা রয়েছে তার। যেটির দাম কোটি টাকার ওপরে। জামালপুর শহরের শহীদ হারুন সড়ক ও মেলান্দহ পৌর এলাকার জিন্নাহ মার্কেটে মাশমির বাজার নামে দুটি সুপার শপ রয়েছে। এই দুই সুপার শপ লোকসানে চললেও সেখানে লাভ দেখাচ্ছেন মাসুম। এছাড়া দামি গাড়িতে চলাফেরা করেন তিনি। মেলান্দহের ফুলছিন্না এলাকায় ৯৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। জিন্নাহ মার্কেটের পেছনে হাজী কলোনিতে মাসুমের বাবার নামে থাকা দোতলা বাড়িটি নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুলভাবে।
এ বিষয়ে জানতে মাসুমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যেভাবেই হোক একটা সময় আয় করেছি। আর আমি সবকিছু খুব সেন্সিটিভভাবে মেইনটেইন করি। যাতে দুনিয়া উল্টে গেলেও কেউ আমার সম্পদ অবৈধ ঘোষণা করতে না পারে। এই কথা বলেই লাইন কেটে দেন। পরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি।
জামালপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, মাসুমের মতো জামালপুরে অনেকে আছে। যারা অনলাইনে জুয়া খেলে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আবার অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। দুদকের উচিত এসব ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা। তাহলে অনেকেই এই অনলাইন জুয়ার থাবা থেকে বেঁচে যাবে।
এদিকে অনলাইন জুয়াকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের ২৭ মার্চ নিহত হন উজ্জ্বল নামের এক যুবক। তার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজের ৫ দিন পর পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত উজ্জ্বলের বাবা উশর আলী বলেন, অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।
এছাড়া অনলাইন জুয়ার কারণে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার বাসিন্দা নাসিম (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, অনলাইন জুয়ার লোভে পড়ে আমি সব হারিয়েছি। প্রথমে দু-একবার জিতলেও এরপর শুধু হারতে থাকি। এভাবে সব শেষ হয়ে গেছে আমার।
জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো ডাউন করতে বিটিসিএলকে অনুরোধ করা হবে। এছাড়া নির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শোভন/কেআই