ঢাকা     বুধবার   ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৩ ১৪৩১

ভবদহে পানিবন্দি ২৫ গ্রামের মানুষ, মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা 

সাকিরুল কবীর রিটন, যশোর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৫:১৫, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ভবদহে পানিবন্দি ২৫ গ্রামের মানুষ, মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা 

অভয়নগরে চলিশিয়া ইউনিয়নের ডুমুরতলা গ্রাম

ভারি বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় যশোরের দুঃখখ্যাত অভিশপ্ত ভবদহ অঞ্চলে ফের মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিতে পারে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী। জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে ভবদহ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার। পানিবন্দি ২৫ গ্রামের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করলেও মেলেনি কোনো সরকারি সহায়তা। বাসিন্দারা কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন গবাদিপশু। ভেসে গেছে শত শত মাছের ঘের।  তলিয়ে গেছে অর্ধশত হেক্টর জমির সবজি ও ফসলি ক্ষেত। 

এরই মধ্যে ভবদহ অঞ্চলকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে পানি সম্পদ উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর দেওয়া স্মারকলিপিতে দাবি করা হয়েছে, বিগত সময়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় কতিপয় শীর্ষ জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদার ও ঘের মালিক সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে ভবদহ স্লুইচ গেট থেকে ৬০ কিলোমিটার নদী অস্তিত্ব হারিয়েছে। ফলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বারোয়াড়িয়া মোহনা পর্যন্ত যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরা জেলাধীন নদী অববাহিকার একশ’ কিলোমিটার জনপদের চার শতাধিক গ্রাম, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, বাড়িঘর ও চাষাবাদ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হতে চলেছে। 

অভয়নগরে সুন্দলি ইউনিয়নের ডহরমশিয়াহাটি গ্রাম

স্মারকলিপিতে ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সাথে মতবিনিময়ের উদ্যোগ গ্রহণে অন্তবর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে নেতৃবৃন্দ অনুরোধ জানান। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলাসহ খুলনা জেলার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার পানি নিষ্কাশনের জন্য ১৯৬৮ সালে অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নের কালিশাকুল গ্রামের ভবদহ নামক স্থানে নির্মিত হয়েছিল ২১, ৯, ৬ ও ২ ভেন্টের স্লুইজ গেট। পরবর্তীতে টেকা, পশুর ও শ্রীহরি নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ১৯৮৫ সাল থেকে জলাবদ্ধতার প্রকোপ শুরু হয় এ অঞ্চলে। জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সরকার উদ্যোগ নিলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। যে কারণে টানা বৃষ্টিপাত হলেই ভবদহ অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী, চলিশিয়া ও পায়রা ইউনিয়নের ২৫ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। 

সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট তিন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, বসতবাড়ির উঠানে কোমর পর্যন্ত পানি জমে রয়েছে। ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ। গবাদিপশু ও মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছে। কোটা, চলিশিয়া, বাগদাহ, আন্ধা, বলারাবাদ, বেতভীটা, সরখোলা, ডুমুরতলা, সুন্দলী, ডহর মশিয়াহটী, বাড়েধা, দীঘলিয়া, ভাটাডাঙ্গী, বারান্দিসহ ২৫ গ্রামের হাজার হাজার পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। 

জলাবদ্ধতার শিকার আন্ধা-বলারাবাদ সড়ক

সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, সম্প্রতি অতি বর্ষণ ও নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে আমার ইউনিয়নের বিল সংলগ্ন গ্রামগুলো জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। কয়েক’শ মাছের ঘের ভেসে গেছে। প্রায় ১২৫ হেক্টর জমির সবজি ও ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা বা ক্ষতির পরিমান নিরুপণ করতে দেখা যায়নি। 

চলিশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সানা আব্দুল মান্নান আক্ষেপ করে বলেন, এবারের জলাবদ্ধতায় অভয়নগর উপজেলার সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমার ইউনিয়ন। কিন্তু মেলেনি কোনো সরকারি সহায়তা। 

পায়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান আত্মগোপনে। তবে সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, শতাধিক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। কি পরিমান ফসলি ক্ষেত ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে তা নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। দ্রত ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। 

প্রবির কুমার রায়, সোহাগ বিশ্বাস, আমিনুর রহমান বাঘা, আক্তারুজ্জামান, জালাল মোল্যাসহ ক্ষতিগ্রস্ত ঘের মালিকরা জানান, অতি বর্ষণ ও উজানের পানির কারণে তাদের হাজার হাজার বিঘা মাছের ঘের ভেসে গেছে। 

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, অভয়নগরে ৩ ইউনিয়নে ১২০ হেক্টর জমির ৩২০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ৫ কোটি টাকা। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন, রোপা-আমনের ৫৯০ হেক্টরসহ ৩৫ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ ব্যাপারে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ভবদহের স্লুইজ গেটে ৪টি পানির পাম্প চলমান রয়েছে। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যা বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে। 

/টিপু/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়