ঢাকা     বুধবার   ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৩ ১৪৩১

ছুটি ঘোষণার পরেও বিগবসে আগুন, শ্রমিকদের সঙ্গ দেয় বহিরাগতরা

রেজাউল করিম, গাজীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২০:০৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ছুটি ঘোষণার পরেও বিগবসে আগুন, শ্রমিকদের সঙ্গ দেয় বহিরাগতরা

পুড়ে যাওয়ার পর ‘বিগবস’ কারখানার একাংশ

বেক্সিমকো থেকে বিগবস করপোরেশন লি. কারখানার দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। বেক্সিমকোতে বুধবার (১১ সেপ্টম্বর) বকেয়া বেতনের দাবিতে উত্তাল ছিলেন শ্রমিকরা। সকাল তখন ৯টা বাজে। বেক্সিমকোর এক থেকে দেড়শ’ শ্রমিক বিগবস কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে চলে যান। 

এরপর চলে কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। পরিস্থিতি খারাপ দেখে ছুটি দেওয়া হয় বিগবস কারখানা। তবে ভেতরে শ্রমিক রয়েছে এমন গুঞ্জনে শতশত শ্রমিক ছুটে আসেন বিগবস কারখানার দিকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বহিরাগত বেশ কিছু যুবক-কিশোর। তাদের অধিকাংশের হাতে ছিল লাঠি, হাতুড়ি, শাবল ও প্লাস্টিকের পাইপ। এরপর কারখানার দ্বিতীয় গেট ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। 

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে সরেজমিনে ওই কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, এখনো পোড়া স্তূপ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে টিনের গোডাউন, একটি এসি বাস, কয়েকটি মোটরসাইকেল ও কয়েকটি গোডাউনে ভর্তি কোটি টাকার ফেব্রিকস। কারখানার কিছু শ্রমিক পালাক্রমে এসব পুড়ে যাওয়া মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। ক্ষোভ ও দুঃখের ছাপ তাদের প্রত্যেকের মুখে। দ্বিতীয় গেট পুরোপুরি ভাঙা। মূল গেটের সামনে শতশত ইটের টুকরো পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বিধ্বস্ত কোনো এলাকা এটি।

কারখানা শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগবস কারখানায় প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক রয়েছে। এদের বেতন কখনো বকেয়া থাকে না। প্রতি মাসের ৮ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়। কারখানাটি গাজীপুরের কাশিমপুর ভবনীপুরে অবস্থিত। এই কারখানা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেক্সিমকো কারখানা। গত কয়েকদিন হলো বকেয়া বেতনের দাবিতে তাদের শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছে। গত বুধবার সকালে আন্দোলন চলাকালে হঠাৎ ৯টার দিকে দেড় থেকে দুইশ’ শ্রমিক বিগবস কারখানায় আসে। এরপর কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের বের হতে বলে। 

ছুটি দিতে একটু সময় লাগে, তবুও তাদের আশ্বাস দেওয়া হয় ছুটি দেওয়া হবে। এক পর্যায়ে তাদের সাথে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি পাঠানো হয়, যেনো ভাঙচুর না করে। তারপর কারখানা ছুটি দেওয়া হয়। তবে সকাল ১১টার পর বেক্সিমকো ও দেওয়ান নামে কারখানার শতশত শ্রমিক চলে আসে বিগবসের সামনে। তাদের সঙ্গে বখাটে, কিশোর বয়সী বহিরাগতরাও ছিল। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠিসোঁটা, ইট, হাতুড়ি, শাবল প্রভৃতি ছিল। 

প্রথমে তারা কারখানার ভেতরে শ্রমিক আছে বলে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। এসময় তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে ইলেকট্রনিক্যাল বিভাগের এজিএম হাদিউলসহ এডমিন ও শ্রমিক মিলিয়ে অন্তত ৫০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে তিন জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 

এরপর তারা মেইন গেট ভাঙতে চেষ্টা শুরু করে। সেটি ভাঙতে না পেরে দ্বিতীয় গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে গোডাউন ও ফেব্রিকসের রুমে আগুন দেয়। পাশে থাকা বাস ও অন্যান্য জিনিসপত্র ভাঙচুর করে।

কারখানার পাশের দোকানদার ও সিকিউরিটিরা জানান, ফেব্রিকস থাকায় মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে যায়। সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের দু’টি গাড়ি ঘটনাস্থলে এলে একটি গাড়ি ভাঙচুর করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদি ওই সময়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঢুকতে পারতেন, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। মূলত লাঠিসোটা হাতে শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগত ছিল। তাদের মধ্যে অনেকের বয়স ১২-১৩ বছর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হট্টগোলের সুযোগে লুটপাট করা। তাছাড়া সাধারণ শ্রমিকরা এতটা হিংস্র ছিল না। 

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, ‘বিগবস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে আমাদের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে পৌঁছলে শ্রমিকরা আমাদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। দমকল কর্মীদের ওপরও হামলা চালায়, এতে কর্মীরা ফিরে চলে আসেন। পরে আমরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেখানে পৌঁছে ছয় ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি।’

ওই কারখানার নিরাপত্তা কর্মী নাসির উদ্দিন বলেন, ‘লাঠিসোঁটা নিয়ে শ্রমিকরা প্রথমে মেইন গেট ভাঙতে চায়। না পেরে ইটপাটকেল মারে। আমাদের অনেকেই আহত হয়। পরে তারা দ্বিতীয় গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগতরাও ছিল, যাদের শ্রমিক বলে মনে হয়নি।’ 

স্থানীয় লতিফপুর গ্রামের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক সুনাম রয়েছে। সাধারণ শ্রমিক ছিল কিন্তু এদের সঙ্গে আরও অনেক লোক ছিল যারা শ্রমিক নয়। এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। লুটপাট ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল। তাদের হাতে বিভিন্ন দেশিয় অস্ত্র ছিল এবং সংখ্যায় তারা অনেক বেশি ছিল। এজন্য আমরা তাদের প্রতিহত করতে পারিনি।’

স্থানীয় দোকানদার জহুরা খাতুন বলেন, ‘সকালে কয়েকবার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। কয়েকজন আহতও হয়। তখন লোকসমাগম কম ছিল। ১১টার পর মিছিল নিয়ে শ্রমিকরা আসতে শুরু করে। এরপর আগুন দেয়। তাদের মধ্যে দোকানের মধ্যে থেকে দেখেছি, যাদের বয়স ১২-১৩ বছর। সবার হাতেই শাবল, লাঠিসোঁটা। তারা আমাদের দোকানও ভাঙচুর করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সবকিছু লুটপাট করা।’

বিগবস করপোরেশন লি‌মিটেড এডমিন ম্যানেজার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে আমাদের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও গাড়ি ও অন্যান্য জিনিস পুড়িয়ে দিয়েছে। এই হামলা ও অগ্নিসংযোগে অন্য কোনো যড়যন্ত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে আজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং হয়েছে।’

গাজীপুর/সনি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়