ক্লাস না করিয়ে ১৩ বছর বেতন তুলেছেন শিশির
মাগুরা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
শিক্ষক শিশির মাগুরা-২ আসনের সাবেক এমপি ড. বীরেন শিকদারের এপিএস হিসেবে পরিচত
মাগুরার শালিখা উপজেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্লাস না করিয়ে গত ১৩ বছর ধরে বেতন তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত শিক্ষকের নাম শিশির সরকার। তিনি উপজেলার অভয়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)।
অভিযুক্ত শিশির মাগুরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদারের ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা।
এদিকে, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছে শিক্ষা অফিস। অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আলমগীর কবির।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে শিশিরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার পর কখনো নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেননি শিক্ষক শিশির। প্রায় সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাবেক সংসদ সদস্যের সঙ্গে দেখা যেত তাকে। সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার সখ্য থাকায় কেউ বিষয়টি নিয়ে এতো দিন কথা বলতে পারেননি।
অভয়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী শিক্ষক শিশির সরকার অনুপস্থিত। প্রধান শিক্ষকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট বিদ্যালয়ে এসেছিলেন শিশির। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সেদিন দুই মাসের ছুটির দরখাস্ত দেন তিনি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছুটি অনুমোদন দিয়েছে।
প্রধান শিক্ষকের কার্যালয় ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১২ মার্চ অভয়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন শিশির সরকার। এরপর থেকে নিয়মিত বেতন তুলেছেন। সর্বশেষ আগস্ট মাসের বেতনও পেয়েছেন শিশির।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, তারা শিশির সরকার নামে একজন শিক্ষককে চেনেন। তবে, গত ৪ বছরে তার কোনো ক্লাস তারা পায়নি।
উপজেলার আসবা বরইচারা গ্রামে ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত অভয়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩১০ জন। এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৬ জন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, শিশির কখনো নিয়মিত পাঠদান করাননি। বছরের পর বছর নানাভাবে বিষয়টি ম্যানেজ করে আসছেন তিনি।
অভয়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতা মজুমদার জানান, শিশির সরকার মাঝেমধ্যে স্কুলে আসতেন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নারায়ণ বরকে সঙ্গে নিয়ে। সভাপতিকে সামনে বসিয়ে তিনি হাজিরা খাতায় এক মাসের স্বাক্ষর করে চলে যেতেন। সাবেক সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন শিশির। তাই তাকে তিনি কখনো কিছু বলতে সাহস পাননি। তিনি পরিচালনা পর্ষদকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন মেয়াদে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হন আসবা গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ বর। সরকার পতনের পর কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্যের প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবারই নারায়ণ বরকে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন শিশির। এ কারণে বিষয়টিতে কেউ কথা বলতেন না।
বৃহস্পতিবার সদ্য সাবেক সভাপতি নারায়ণ বরের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইলফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি কয়েক দিন আগে চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নারায়ণ বরের স্বজনরা।
এ বিষয়ে কথা বলতে শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) শিক্ষক শিশির সরকারের মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাগুরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ মানুষরা। সেদিন থেকেই বীরেন শিকদার আত্মগোপনে রয়েছেন। এ কারণে তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
জেলা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আলমগীর কবির বলেন, ‘শিশির সরকার যে ক্লাস না করিয়ে বেতন তুলেছেন, এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মমতা মজুমদার গত বৃহস্পতিবার লিখিতভাবে আমাদের জানিয়েছেন। এ বিষয়ে এর আগে কেউ আমাদের অভিযোগ করেননি।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছে শিক্ষা অফিস। অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
শাহীন/মাসুদ