ঢাকা     শনিবার   ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২০ ১৪৩১

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুট

বন্ধন পরিবহন ও বাস টার্মিনালের কর্তৃত্ব নিয়ে দুই গ্রুপ মুখোমুখি

নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৯, ৫ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ১১:২৭, ৫ অক্টোবর ২০২৪
বন্ধন পরিবহন ও বাস টার্মিনালের কর্তৃত্ব নিয়ে দুই গ্রুপ মুখোমুখি

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করা বন্ধন পরিবহন এবং বাস টার্মিনালের কর্তৃত্ব নিতে এখন মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপির দু’টি গ্রুপ। একটির নেতৃত্বে কারাবন্দী সাবেক ছাত্রদল সভাপতি জাকির খান। অপর গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন ক্রসফায়ারে নিহত যুবদল নেতা মমিনউল্লাহ ডেভিডের ছোট ভাই মাহাবুবউল্লাহ তপন ও ভাগ্নে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন রানা।

ইতোমধ্যে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।আহত হয়েছে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন।একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে পাল্টাপাল্টি মামলা করেছেন। আসামি করা হয়েছে দুই গ্রুপের লোকজনদের। এরই মধ্যে জাকির খানের লোকজন বাস চালানোর পর সেখানে ভাঙচুর করা হয়েছে অভিযোগ উঠেছে। তবে পাল্টা অভিযোগ করেছেন রানার লোকজনও। এ নিয়ে শহরে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা ও আতঙ্ক। 

জানা যায়, বিগত বিএনপির আমলে বন্ধন পরিবহনের বাস ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল শুরু করে। ওইসময়ে মমিনউল্লাহ ডেভিডের ভোট ভাই ও মহানগর বিএনপি সদস্য মাহবুব উল্লাহ তপন বন্ধন পরিবহনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এর নিয়ন্ত্রণ নেন কৃষকলীগ নেতা ইব্রাহিম চেঙ্গিস। পরবর্তীতে শামীম ওসমানের নির্দেশে ২০১৩ সালে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন বন্ধন পরিবহন বিলুপ্ত করে সিটি বন্ধন পরিবহনের চেয়ারম্যান হন। এতে পরিবহনের এমডি ও কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আইয়ূব আলীর নিয়ন্ত্রণে বন্ধন বাস চলাচল করে।

৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিএনপি দুই গ্রুপ পরিবহনটি দখলে নজর দেন। প্রথম পর্যায়ে বিএনপি নেতা কারাবন্দি জাকির খানের সমর্থক লিটন ও দেলোয়ার বন্ধন পরিবহন দখলে নেয়।

২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে বন্ধন পরিহনের কয়েকটি বাসে ‘সিটি বন্ধন’ এর নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘বন্ধন’ পরিবহন লিখে দেন তপনের ভাগ্নে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন রানাসহ তাদের অনুসারী পরিবহন নেতারা। ওই সময়ে তারা ৫৬ টাকা ভাড়ার স্থলে ৫৪ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেন।

এইদিন দুপুর ২টার দিকে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কারাবন্দী জাকির খানের কর্মী মহানগর স্বেচ্ছাসেবকদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়া, দাদা সেলিম, লিংকন, সনেটের নেতৃত্বে শতাধিক নেতাকর্মীরা ঝটিকা হামলা করে। এতে বন্ধন পরিবহনের কাউন্টারে থাকা বাস মালিক রুহুল আমিন মারধরের শিকার হন। এরপর নারায়ণগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন পরিবহন কার্যালয়ে ভাঙচুর ও নেতাদের মারধর করে। পরে বন্ধন পরিবহনের কাউন্টার ও চেয়ার ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে মাহবুব উল্লাহ তপন ও সাখাওয়াত হোসেন রানার লোকজন জাকির খানের লোকজনকে ধাওয়া দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এসময় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ গুলির ঘটনায় সদর মডেল থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের হয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে বন্ধন টান্সপোর্টের এমডি মো. মাহবুব উল্লাহ তপন বাদী হয়ে ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও সাড়ে তিনশ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

অপরদিকে সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেডের পরিচালক সালামতউল্লাহ নাদিম বাদী হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও আড়াইশ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। তবে উভয় মামলাতেই অস্ত্রধারী কাইল্যা রাসেলকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন- রাসেল ওরফে কাইল্লা রাসেল, মো. সুমন বেপারী, মো. জিহান, বাবু ওরফে শিশির, মো. আলী, মো. আল আমিন, মো. শরিফ ও রাজীব।

বন্ধন টান্সপোর্টের এমডি মাহবুব উল্লাহ তপনের দায়েরকৃত মামলার এজাহারনামীয় আসামিরা হলেন- দেলোয়ার হোসেন ওরফে ল্যাপটপ দেলু, মো. সুমন, দাদা সেলিম, শাহাদাত হোসেন খান লিটন, পারভেজ, জিয়া, লিংকন খান, মুরাদ হোসেন, সনেট, শাহিন, শফিকুল ইসলাম, মহসিনুর রহমান, সাদ্দাম হোসেন, আক্তার হোসেন, মো. রতন, শহিদ হাওলাদার, মনির হোসেন ওরফে ধোপা মনির, মিলন হাওলাদার, আইয়ুব আলী, রাসেল ওরফে কাইল্লা রাসেল, মো. সুমন বেপারী, মো. জিহান, বাবু ওরফে শিশির, মো. আলী, মো. আল আমিন, মো. শরিফ, মো. রাজিব ও মো. লিটন।

মামলার অভিযোগে তপন উল্লেখ করেন, আমি ২০০১ সাল থেকে বন্ধন টান্সপোর্ট নামে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে যাত্রী পরিবহন ব্যবসা করে আসছি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসায় কুখ্যাত সন্ত্রাসী শামীম ওসমান, অয়ন ওসমান ও তাদের দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বন্ধন টান্সপোর্ট ও বিভিন্ন স্থানে কাউন্টার জোরপূর্বক দখল করে নেয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২২ সেপ্টেম্বর আমার সঠিক রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্সসহ যাবতীয় সকল বৈধ কাগজ নিয়ে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে দোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। এমন সময় মামলায় নাম উল্লেখিতরা ককটেল বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্র, পিস্তল, ধারালো রামদা, চাপাতি, ছুরি, লোহার রডসহ অতর্কিতভাবে হামলা করে।

সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেডের পরিচালক সালামতউল্লাহ নাদিমের দায়েরকৃত মামলার এজাহারনামীয় আসামিরা হলেন- বন্ধন টান্সপোর্টের এমডি ও অপর মামলার বাদী মো. মাহবুব উল্লাহ তপন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রানা, দেওভোগ আখড়া সংলগ্ন খন্দকার বাড়ির পাশের এলাকার বাসিন্দা হাসান, টানবাজারের রুহুল আমিন, নিত্য সাহা, বাবুল দেওয়ান, মাসদাইর তালা ফ্যাক্টরি এলাকার রাসেল, ভূঁইগড়ের কাশেম, বন্দর একরামপুর ইস্পাহানি এলাকার কামাল উদ্দিন মির্জা জনি, আফাজনগরের হীরা লাল, টানবাজারের সুজন, মাসদাইরের রহিম, কাইল্যা রাসেল।

মামলায় অভিযোগে নাদিম উল্লেখ করেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে পরিবহন ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। উল্লেখিত বিবাদীগণ বিগত কিছুদিন ধরে স্থানীয় প্রভাব বিস্তার করে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল অবৈধ দখল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর বিবাদীগণ শহরের চাষাঢ়া কাউন্টার, যাত্রাবাড়ী কাউন্টার, গুলিস্তান কাউন্টার ও বায়তুল মোকারম কাউন্টারে হামলা করে কাউন্টারের কর্মচারীদের বেধড়ক মারধর করে। এছাড়াও একইদিন সকাল ১০টার দিকে সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেডের ১নং রেল গেইট কাউন্টারে ভাঙচুর এবং কাউন্টারে থাকা কর্মচারীদের বেধড়ক মারধর করে কাউন্টারে থাকা টিকিট বিক্রির ৮৭ হাজার টাকা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দুপুর ২টার দিকে বিবাদীগণ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আবারো হামলা চালিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে স্টাফদের মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে। বিবাদীরা সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেড উচ্ছেদ করে দখলে নেওয়ার হুমকি দেয় ।

২৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে সিটি বন্ধন পরিবহনের অফিসে সংবাদ সম্মেলনে সিটি বন্ধন পরিবহনের এমডি দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের সিটি বন্ধন পরিবহন দখল করে মালিকদের জিম্মি করার চেষ্টা করেছিলেন ক্রসফায়ারে নিহত ডেভিডের ছোট ভাই তপন ও তাদের ভাগিনা রানা। বিএনপি নাম ভেঙে সিটি বন্ধন পরিবহনের মালিকদের জিম্মি করা চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তাদের। কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে কাউন্টার দখল করতে না পেরে এখন চাষাঢ়াসহ অন্যান্য কাউন্টারে তালা মারছে তপনের লোকজন। প্রতিদিন রাতে ওই কাউন্টারে তালা মেরে যাচ্ছে ওরা, এতে মালিকরা আতঙ্কে পড়ে গেছে। ইতোমধ্যে সিটি বন্ধন পরিবহনের বাসগুলোতে ‘সিটি’ লেখা কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের অনেকের নাম পেন্ডিং মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তপনরা অপপ্রচার চালিয়ে বেড়াচ্ছে, আমরা নাকি ছাত্রজনতা আন্দোলনে তাদের বিরুদ্ধে ছিলাম। আমরা সিটি বন্ধনের সকল মালিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেডের এমডি দেলোয়ার হোসেন লিখিত বক্তব্যে বলেন, ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল হতে সিটি বন্ধন পরিবহন লিমিটেডের বাসগুলো পরিচালনা শুরু করি। ওই দিন রাত আনুমানিক ৯টায় মিশনপাড়া মোড়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা হামলা চালিয়ে ২টি গাড়ির সামনের গ্লাস এবং জানালার সাইড গ্লাসগুলো ভাঙচুর করে। গাড়ি নং ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৩২১৪ ও ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-২৩৪৮। জানতে পারি যে, এই গাড়ি ভাঙচুরের নেতৃত্ব দেয় এবং হামলায় অংশ নেয় মাহাবুল্লাহ তপন ও সাখাওয়াত হোসেন রানা। একইভাবে পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের পাশে লিংক রোডে রাত অনুমান সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪০০৫ ও ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৫৫২৯ গাড়ি ২টির সামনের গ্লাস এবং জানালার সাইড ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করে। ড্রাইভার ও হেলপারগণ কর্তৃপক্ষকে জানান ২-৩টি মোটরসাইকেলযোগে সন্ত্রাসীরা এসে গাড়ি ভাঙচুর করে চলে যায়। সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাত অনুমান ৯টায় লিংক রোডের ভূঁইগড় এলাকায় ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৬০২৯৯ ও ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৮৪৩ গাড়ি ২টির সামনের গ্লাস এবং জানালার সাইড একইভাবে পূর্বের ন্যায় ভাঙচুর করে। ভূঁইগড় এলাকায় গাড়ি ভাঙচুরের সময় ভাঙ্গা গ্লাসের আঘাতে নবনীতা নামে ১ জন নারী যাত্রী গুরুতর আহত হন। এ ব্যাপারে ফতুল্লা মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রানা বলেন, আমাদের বন্ধন পরিবহন চালু হয়েছিলো ২০০২ সালে। আর তারা ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে আমাদের বন্ধন পরিবহন বন্ধ করে সিটি বন্ধন নামে চালু করেছিলো। আমরাতো গত ২২ সেপ্টেম্বর আমাদের বন্ধন পরিবহন চালু করতে গিয়েছিলাম। তাদের সিটি বন্ধন পরিবহনের কোন অফিস দখল করিনি। বরং তারাই উল্টো আমাদের উপর হামলা চালায়। সেনাবাহিনীও কিন্তু তাদের লোকজনকেই ধারালো অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিলো। তাদের লোকজনই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমাদের উপর গুলি করেছে। 

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হওয়ায় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে আমাদের আমাদের থানা পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়ে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করি। পরবর্তীতে উভয় পক্ষের মামলা দায়ের হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

অনিক/টিপু


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়