ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

বৃষ্টি-ঢলে ময়মনসিংহে বন্যা, দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৬, ৬ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ১৮:৪৭, ৬ অক্টোবর ২০২৪
বৃষ্টি-ঢলে ময়মনসিংহে বন্যা, দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি

অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তিন উপজেলার ২১ ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিন উপজেলাতেই বিদ্যুৎ সংযোগ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এতে মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে পড়েছে। অতিবৃষ্টিতে জেলাজুড়ে মৎস্যখাতে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও দূর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন রোববার (৬ অক্টোবর) দুপুরে এ সব তথ্য জানিয়েছেন। 

সানোয়ার হোসেন বলেন, উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে এখন নারী শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তিন উপজেলায় ৩০ মেট্রিক টন চাল খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া রান্না করা খাবারও দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

আরো পড়ুন:

স্থানীয়রা জানান, ধোবাউড়া বন্যা দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তবে প্রশাসন কিছু এলাকায় খাবারের ব্যবস্থা করছে। এছাড়াও নেতাই নদীর আশপাশের এলাকায় অন্তত অর্ধশত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলা, পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।

ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বর, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের আংশিক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবাজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

এদিকে, হালুয়াঘাটের প্রায় সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, সবজি খেত ও ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে আছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরের মধ্যে পানি ঢোকার কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে। মানুষজন অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হাছিনা আক্তার বানু বলেন, জেলার ধোবাউড়া উপজেলায় ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ধান নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৪ হাজার ২০০ হেক্টর। আর ৬০ হেক্টর সবজি খেত নিমজ্জিত হয়েছে। হালুয়াঘাটে ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ধান নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে ৪ হাজার ১০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর। আর সবজি খেত নিমজ্জিত হয়েছে ৭৫ হেক্টর। ফুলপুরে নিমজ্জিত ধান ৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর। এরমধ্যে সম্পুর্ণ নিমজ্জিত ১ হাজার ৪৮০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ২ হাজার ১৫০ হেক্টর। আর সবজি খেত নিমজ্জিত হয়েছে ৬২ হেক্টর।

বন্যার পানিতে ধোবাউড়া উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের ডৌমঘাটা গ্রামের কবির সারোয়ার সুজনের ৪০ একর ঘেরের মাছ, দেড়শত একর জমির ধান তালিয়ে গেছে। কবির সারোয়ার সুজন বলেন, ‘৪০ বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছি। জীবনে কখনও এমন পরিস্থিতির শিকার হয়নি। চোখের সামনে ৬টি পুকুরের ৪০ লাখ টাকার কার্প জাতীয় মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। তিন দিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে দেড়শত একর জমির ধান। সবি শেষ হয়ে গেছে।’

আমতৈল গ্রামের সিদ্দিক মিয়া বলেন, ‘রাস্তাঘাটে পানি, ঘরে, রান্না ঘরে পানি। এখনও শুকনা খাবার পেলাম না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।’

কৈচাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ‘এমন বন্যা আগে কখনও দেখি নাই। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখেছি, এমন পানি ছিল না। বাড়িঘরে পানি উঠেছে। গরু ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গরু পানির মধ্যে বাঁধা। আমরা খুব সমস্যায় আছি। চলাফেরা খুব সমস্যা, রাস্তায় বুক সমান পানি। ফসলের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান পানির নিচে পড়ে গেছে। এবার আমন ধান পাব, এমন আশা করা যায় না। অনেক শাকসবজির জমি তলিয়ে গেছে।’

বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘ভারত সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি এলাকায় পাহাড়ি ঢল এবং অতিবৃষ্টির কারণে যেমন প্লাবিত হয়েছে, এ রকম পানি বিগত ১৫-২০ বছরে আমরা দেখেনি। এখানে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মানুষের বাড়িঘর, জমির ফসল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব নষ্ট হয়ে গেছে। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় বিস্তৃীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্লাবিত এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার জন্য আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি। আজকে এখানে বিভাগীয় কমিশনার এসেছিলেন, উনার সঙ্গে কথা বলেছি এবং অন্যান্য প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ দেবেন। আমরা নিজেদের যা সামর্থ্য আছে, সেটা নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছি। আমরা প্রথম দিন থেকে মানুষকে উদ্ধার, আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, খাবার বিতরণ করে আসছি। প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা তালিকা করে তাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ৭ হাজার ৮০ জন মৎস্য চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

রোববার (৬ অক্টোবর) সকালে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, ‘আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। বন্যাদুর্গত মানুষের খাদ্যসহ, যে চাহিদা; সেই মোতাবেক সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে। উপজেলাগুলোতে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছি। সবাই একসঙ্গে কাজ করছে। তাদের জন্য রান্না করা খাবার শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। সবাই মনে করছি, যদি বৃষ্টি কমে যায়; তাহলে পানি নেমে যাবে। তবে বৃষ্টি কমছে না। আবহাওয়া অফিস বলছে, আরও একদিন বৃষ্টি থাকতে পারে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।’
 

মিলন/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়