বন্যা পরবর্তী লক্ষ্মীপুর
‘পানি কমলে এসে দেখি ঘরের একটা বেড়াও নেই’
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
লক্ষ্মীপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি টিনের ঘর
লক্ষ্মীপুরে বন্যায় ৪০ হাজার ৮০১টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘরের বেশিরভাগই কাঁচা। ঘর মেরামত নিয়ে এখন দুঃচিন্তায় মালিকরা। দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা থাকায় দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের আয় রোজগার অনেকটা বন্ধ ছিল। এ সময় নিজেদের খাদ্যের জোগান দিতেই কষ্ট হয়েছে তাদের। এখন বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট ঘর মেরামত। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা এখন ঘর মেরামত করে ঘুরে দাঁড়ানোকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।
জেলার সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের পশ্চিম দিঘলী গ্রামের কৃষক মমিন উল্যার বসতঘরটি বন্যার পানিতে তলিয়ে ছিল। খুঁটি ভেঙে ঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে আছে। বন্যায় তিনিও অর্থ সংকটে পড়ে ঘর মেরামত নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।
মমিন উল্যা বলেন, ‘বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রান্না ঘর এবং গোয়াল ঘরও জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। ঘরের ভিটার মাটি পানির তোড়ে চলে গেছে। ঘর মেরামত করতে দুই লাখ টাকার মতো লাগবে। আমি কৃষক। কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। বন্যায় তো কৃষিও শেষ। এবার ঘর করবো কি দিয়ে? আয়-রোজগারও নেই। সংসারে খাবার জোগাতেই কষ্ট হয়।’
একই গ্রামের একটি বেড়িবাঁধের পাড়ে থাকেন গৃহবধূ রানু বেগমের। তার স্বামী প্রবাসী। সন্তান এবং শাশুড়িকে নিয়ে টিনের তৈরি ঘরে থাকতেন তিনি। গত দেড় মাস আগে তার ঘরে বন্যার পানি ওঠে। পানি যখন ঘরে খাটের কাছাকাছি চলে আসে, তখন ঘরে থাকা সম্ভব হয়নি রানুর। ছেলে এবং শাশুড়িকে নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ঘরের অর্ধেকাংশ পানির নিচে তলিয়ে থাকায় বাঁশ ও বেড়া পঁচে যায়। এছাড়া পাশে থাকা বড় একটি কড়ইগাছ পড়ে ঘরটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে তার। খাটসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ভেঙে গেছে। রানু বেগম এখন ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামতের কাজ শুরু করেছেন। পুরো ঘর মেরামত করতে তার লাখ টাকার বেশি খরচ হবে। তবে, রানুর মতো ঘর মেরামত করার সামর্থ্য নেই এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের।
ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামতের কাজ করছে কয়েকজন শ্রমিক
রানুর এলাকার বাসিন্দা বিধবা জাহেদা বেগম। বন্যায় তার ঘরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জরাজীর্ণ এই ঘর নিয়ে তার দুঃচিন্তা যেন শেষ নেই। কিভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পুনরায় মেরামত করবেন, সে ভাবনায় যেন ঘুম নেই এ বিধবার।
জাহেদা বলেন, ‘পেটে ভাত জুটাতে কষ্ট হয়, ঘর মেরামত করবো কি দিয়ে। স্বামী নেই, নিজেই গরু লালন পালন করি। দুধ বিক্রি করে সংসার চালাই। বন্যা আসায় গরুর খাবার জোগাড় করতে পারি না। গরু দুধও দেয় না। এখন সংসারই চলে না। ভাঙা ঘর মেরামত করার অর্থ পাব কই?’
বেড়িবাঁধের পাশে বৃদ্ধ মোস্তফা এবং নুরজাহান দম্পতির বসবাস। ঝুপড়ি ঘর ছিল তাদের। বন্যা শুরু হলে বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। এখন পানি নামার পর ঘরে ঢুকেছেন। তাদের ঘরটির বেড়া দিয়েছেন সিমেন্টের বস্তা দিয়ে। আর ঘরের উপরে টিনের চালা থাকলেও ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। তাই জরাজীর্ণ টিনের উপরও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে রেখেছেন এই দম্পতি।
মোস্তফা-নুরজাহান দম্পতি জানান, আয় রোজগার নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খুঁজে খাবার আনতে হয়। ঘর মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই।
এদিকে, এলাকার সুরাইয়া বেগমের বাড়িতে এখনো বন্যার পানি রয়েছে। পানি ঘর থেকে নামলেও উঠোনে রয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় পানি থাকায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ঘরটি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে এখন রাজ্যের চিন্তা ভর করেছে এ নারীর। কারণ তার সংসারই ঠিকমতো চলে না। প্রায় ২০ বছর আগে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। এক সন্তানকে নিয়ে থাকেন এই নারী। ঢাকায় একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে চাকরি করে তার ছেলে।
সুরাইয়া বলেন, ‘বন্যার পানি উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরের পশ্চিম পাশের অংশ ভেঙে পড়ে। ঘরটি কাত হয়ে যায়। পানিতে ঘরের মাটি সব চলে গেছে। মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই। দুই লাখ টাকার মতো মেরামতে খরচ আসবে। টাকা জোগানোর কোনো শক্তি নেই আমার। কি-যে কষ্টে আছি, বলে বুঝাতে পারবো না। অন্যের বাড়িতে আপাতত আশ্রয় নিয়ে থাকি।’
পূর্ব দিঘলী গ্রামের মারজান বেগম বলেন, ‘শুরুতে পানি ঘরের সামনে ছিল। পরে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বন্যার পর বাড়িতে এসে দেখি ঘরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন কোনো রকমে থাকি। রান্নাঘর ভেঙে গেছে। স্বামী অসুস্থ, হাত ভেঙে ঘরবন্দি। আয় রোজগার নেই। ঘর মেরামতের অর্থও নেই।’
একই গ্রামের বৃদ্ধা মোবাশ্বেরা বেগম বলেন, ‘ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করতাম। বন্যার পানি উঠলে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠি। পানি কমলে এসে দেখি ঘরের একটা বেড়াও নেই। এগুলো মেরামত করার মতো অর্থ বা সাধ্য আমাদের নেই। পরিবারের আটজন সদস্য এই ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করি।’
লক্ষ্মীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া বলেন, ‘বন্যায় জেলাতে কাঁচা ও পাকা ৪০ হাজার ৮০১টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৩৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সহায়তা আসতে পারে। বরাদ্দ সাপেক্ষে অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে।’
জাহাঙ্গীর/মাসুদ