কিশোরগঞ্জ
দুর্গাপূজা উপলক্ষে জমেছে ৫০০ বছরের ঐতিত্যবাহী ঢাকের হাট
রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
ঢাক-ঢোল ও সুরের মূর্ছনা ছাড়া দুর্গাপূজা পূর্ণতা পায় না। তাই পূজার প্রতিটি পর্বে চাই ঢাকের আওয়াজ ও সুরের মূর্ছনা। এ প্রয়োজনকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে জমে উঠেছে ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। মঙ্গলবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলবে বুধবার (৯ অক্টোবর) গভীর রাত পর্যন্ত। হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাক-ঢোলসহ নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে দুই শতাধিক বাদকদল।
সরেজমিনে কটিয়াদীর পুরান বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনায় মুখরিত পুরো বাজার। বাদ্যের তালে তালে চলছে সুরের লড়াই। কেউ ঢাক, কেউ ঢোল আবার কেউ বাঁশি-সানাইয়ের সুরে নিজেদের দক্ষতা উজাড় করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে পুরো হাটে সুর তালের অন্যরকম আবহ। আর এসব ঘুরে ঘুরে উপভোগের পাশাপাশি, তাদের দক্ষতা যাচাই করছেন পূজা আয়োজকরা। চলছে কথাবার্তা দরদামও। বাজনা পছন্দ ও দরদামে মিল হলে সেই বাদকদলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন পূজারিরা। প্রতি বছরের মতো এবারো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঢাকিদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাট মানে বেচাকেনার জায়গা হলেও এই হাটটি একটু ভিন্ন। এখানে বাদকরা টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন পূজা আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। তাই হাটে আসা লোকজনকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আকর্ষণের চেষ্টা করেন তারা।
বাদকরা জানান, হাটটি আসলে বছরের পর বছর একটি রীতিতে তৈরি হয়েছে। তাই তারাও দলবল নিয়ে হাজির হন। এই হাটের একটি ভালো বিষয় হলো, চুক্তি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। প্রতিবারই দলগতভাবেই বিভিন্ন পূজা আয়োজকদের সাথে চুক্তি হয়। যেখানে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায় চুক্তিমূল্য।
প্রায় আট বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের পাগলা থেকে সাত জনের একটি দল নিয়ে এখানে আসেন জীবন কুমার রায় (৪৭)। তিনি জানান, এই হাটে বছরের পর বছর ভালো বায়নায় চুক্তি পেয়েছি। আমার পূর্ব পুরুষের হাত ধরেই এ হাটে আসা শুরু করি। হাটে বাজনা বাজিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শন দেখাচ্ছি। আশা করছি, কারো না কারো সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাব।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থেকে ঢাকিসহ বিভিন্ন বাদ্যের একটি দল ভাড়া নিতে এসেছেন মহাদেব সাহা। তিনি জানান, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হাটে ঘুরছি, বিভিন্ন বাদকদলের সঙ্গে কথাও বলছি। এখানে যারা আসেন মোটামুটি সবাই বেশ ভালো বাদক। তাদের বাদ্যযন্ত্র ও বাজনা আমাদের পরখ করা হয়েছে। প্রতি বছরই এখান থেকে বাদকদলের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তাদের নিয়ে যাই। তাই এবারও এসেছি। মুন্সীগঞ্জের একটি দলকে পছন্দ হয়েছে। সেই দলে যারা আছেন, সবাই বেশ ভালো বাদক। দাম-দর ঠিক থাকলে চুক্তি করব।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কটিয়াদী উপজেলা শাখার আহ্বায়ক বিপদ সাহা বলেন, প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাটে প্রায় ৫০০ বাদকদল অংশ নেন। কটিয়াদি পুরান বাজারে এই হাটটি হয়। তবে এই বছর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকিদের উপস্থিতি কিছুটা কম।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলে কটিয়াদীতে প্রথম ঢাকের হাটের সূচনা হয়। তিনি ওই সময় রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। একবার তিনি পূজার প্রয়োজনে সেরা ঢাকির সন্ধানে বিক্রমপুরে বার্তা পাঠান। তখন নৌ পথে বহু ঢাকি কটিয়াদী আসেন। রাজা নিজে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন। সেই থেকেই প্রচলন শুরু এই ঢাকের হাটের।
কেআই