ঢাকা     শনিবার   ১৯ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ৩ ১৪৩১

লালনের ভক্তরা শুধু মানুষের ভজন করে, নেশার নয়: ফরহাদ মজহার

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২২, ১৯ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ১৩:৪৩, ১৯ অক্টোবর ২০২৪
লালনের ভক্তরা শুধু মানুষের ভজন করে, নেশার নয়: ফরহাদ মজহার

বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেছেন, মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইকে যুগে যুগে বাউল সম্রাট উল্লেখ করে তাঁর মানবতার কল্যাণের ফকিরিবাদ মতামতকে ক্ষতি করে আসছে। 

ফকির লালন সাঁই মানব সেবার ব্রত নিয়ে অসংখ্য গান লিখে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সংগীতে কখনই বাউল শব্দ ছিল না। তাঁর গান কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এদিকে যেমন তাঁর সৃষ্টি ছড়িয়েছে বিশ্বে তেমনি তাঁকে নিয়ে হচ্ছে উন্নতর গবেষণা। মূলত নদীয়ার পাঁচটি ঘরের ধারাকেই লালন ফকিরিবাদের মূল ধারা হিসেবে প্রচলন করে গেছেন। সমাজের হানাহানি দূর করে মানুষকে শান্তির পথ দেখিয়েছে লালন সাঁইয়ের মানবতাবাদ। 

শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) রাতে  বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাটের ১৩৪ তম তিরোধান দিবসের ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের ২য় দিনে প্রধান অতিথি ও মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ফকির লালনের ভাবধারা যুগে যুগে মেয়ে সঙ্গী এবং নেশাদ্রব্য দিয়ে বিচ্যুৎ করা হয়েছে। যার আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ভাব সাধকের এই পবিত্র জায়গায় এধরনের প্রচলন চলতে দেওয়া যাবে না। যেমনভাবে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আজকের প্রজন্ম সাধনার জায়গায় বজ্জাতিকে মেনে নিবে না। তাদেরও বিদায় করবে। 

তিনি বলেন, মানুষের ধারণা এসব মাজারে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়া হয়। তাই আজকে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর মাজার ভাঙা হচ্ছে। মাজার ভাঙা ফৌজদারি অপরাধ। প্রশাসনকে বলবো এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিন। লালনের ফকিরি ভাবের সত্য প্রকাশ না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার দায় লালন একাডেমিকে নিতে হবে।

তিনি বলেন, লালনের মূল জায়গা শুধুই ভাবনগর। লালনের ভক্তরা শুধু মানুষের ভজন করে, নেশার নয়। আমাদের ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে হবে। এখানে নেশাদ্রব্য নিষিদ্ধ। লালনের চর্চা সঠিকভাবে করতে নেশা হবে ভাবের, নেশা প্রজ্ঞার, নেশা হবে মানবতা। যা দিয়ে আমরা নিজেদের জয় করতে পারি। লালন সাঁইয়ের ফকিরি মতবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণের প্রতিষ্ঠান ‘নবপ্রাণ’ এবং ‘লালন একাডেমি’ হতে হাত রেখে এক সাথে চলবে। 

তিনি সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহবান রেখে বলেন, লালন একাডেমি ফকিরদের প্রতিষ্ঠান ফকিরদের হাতেই ছেড়ে দিন।

তিনি বলেন, নদীয়ার প্রথম ফকির হল চৈতন্য। লালন সাঁই চৈতন্যের ভাবধারায় নিজেকে ফকির হিসেবে গড়ে তোলেন। লালনের এই প্রসার কোনো ভাবেই ভারত মেনে নেয়নি। যুগে যুগে ভারত পরিকল্পিতভাবে এদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে দেয়নি, বর্তমানেও দিচ্ছেনা। দিল্লি ক্রমাগতভাবে আমাদের নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই মহাজ্ঞানী মহাত্মা লালনের সৃষ্টির কীর্তি আজ আর কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ির মধ্যে আবদ্ধ নেই। লালন সাঁই জাত-ধর্মের সীমাবদ্ধতার বাইরে মানুষকে সবার উপর তুলে ধরেছেন। বাংলার ভাবজগৎ বর্তমান বিশ্ব অনেকটাই সমৃদ্ধ।

তিনি আজকের প্রজন্মের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, আজকের প্রজন্মকেই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যেমন এদেশকে গড়ে তুলতে হবে তেমনি বেশি বেশি লালন চর্চা করে কুষ্টিয়াকে ভাবনগর হিসেবে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব নিতে হবে। 

তিনি আরো বলেন, তাঁর কর্মসাধনা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধুরা এই আখড়াবাড়িতে এসে সত্য পথে চলার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে নিজেদের আলোকিত করছেন।

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসের ৩ দিনের অনুষ্ঠানমালার ২য় দিন শুক্রবার রাতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোছা. শারমিন আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, কুষ্টিয়া জজ কোর্টের সাবেক পিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. গোলাম মহম্মদ, ছাত্র-জনতা প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান, তৌকির আহমেদ প্রমুখ। 

স্বাগত বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মিজানুর রহমান।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই আগত অতিথি ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের কুষ্টিয়া লালন একাডেমির পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া, ক্রেস্ট ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক একতারা উপহার দিয়ে বরণ করে নেন। 

দ্বিতীয় পর্বের সংগীতানুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন লালন একাডেমির সাবেক সদস্য বাউল আব্দুল কুদ্দুস। সংগীত পরিবেশন করেন সমির বাউল, সুফিয়া কাঙালিনী। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই সংগীত পরিবেশন। 

তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানের সার্বিক উপস্থাপনা ও পরিচালনা করেন ফারহানা ইয়াসমিন ও কনক চৌধুরী।

কাঞ্চন/টিপু


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়