ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ২১ ১৪৩১

বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌ টার্মিনাল

যমুনার জলে ১৪৫ কোটি টাকা, একদিনও ঘোরেনি ফেরির চাকা

মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ৪ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২২:৫৯, ৪ নভেম্বর ২০২৪
যমুনার জলে ১৪৫ কোটি টাকা, একদিনও ঘোরেনি ফেরির চাকা

উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করতে যমুনার দুই পাড়ের ঘাট ঘিরে ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। গাইবান্ধার বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত নৌরুটে ফেরি সার্ভিসের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। তবে পাঁচ বছরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে এটি। ফেরি চালু করতে না পারায় অলস পড়ে আছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন সব স্থাপনা। যেন যমুনার জলে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। একদিনও ঘোরেনি ফেরির চাকা।

জানা যায়, ১৯৩৮ সালে তিস্তামুখ ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট চালু হয়। এই দুঘাটে ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ চালু ছিল। ১৯৯০ সালে নদীর নাব্য সংকটের অজুহাতে তিস্তামুখ ঘাটটি স্থানান্তর করা হয় একই উপজেলার উজানে বালাসীতে। নতুন করে সেখানেও ব্যয় করা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। নির্মাণ করা হয় ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বালাসীঘাট পর্যন্ত নতুন প্রায় ৬ কিলোমিটার রেলপথ। সেখানেও কয়েক বছর চলার পর যমুনায় নাব্য হ্রাসের কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে পুরোপুরি এ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লঞ্চ ও ফেরি না থাকলেও প্রয়োজনের তাগিতে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করেন দুই পাড়ের মানুষ। 

সূত্র জানায়, যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে ২০১৪ সালে বিকল্প নৌরুট তৈরির যুক্তি দেখিয়ে বালাসী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর একনেকের সভায় বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটটি চালু করতে ‌‌‘বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের’ অনুমোদন দেওয়া হয়। সেসময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে দুই দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে দাঁড়ায় ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। 

২০২১ সালের মধ্যে কিছু স্থাপনা নির্মাণ কাজ শেষ হলে হঠাৎ করে বিআইডব্লিউটিএ-এর কারিগরি কমিটি নাব্যতা সংকট ও ২৬ কিলোমিটার দূরত্বের কথা তুলে ধরে নৌ রুটটি চলাচলের অনুপযোগী বলে ঘোষণা করে। একই বছরের এপ্রিলে নৌ-রুটটির সমস্যা খুঁজে দেখতে বিআইডব্লিউটিএ একটি কমিটি গঠন করে। পরে কমিটির প্রতিবেদনে ভৌত কাজের গুণগতমান ও কাজের তদারকির অভাব, নাব্যতা সংকট-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাসহ নানা দিক তুলে ধরে এই পথে ফেরি চলাচল অনুপযোগী বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। 

২০২১-২২ অর্থবছরের জুনে বৃহত্তর এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নদীর মরফোলজিক্যাল অবস্থা না জেনেই দুই পাড়ে ঘাট নির্মাণ করায় বালাসী ঘাট ও বাহাদুরাবাদের দুই প্রান্তের ফেরিঘাট অন্যত্র স্থানান্তর করতেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভিন্ন কাজে ব্যবহারের সুপারিশও করে ওই কমিটি। 

২০২২ সালের ৯ এপ্রিল নৌপথটি উদ্বোধন করতে যান তৎকালীন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। উদ্বোধনের দিনই নাব্যতা সংকট নিয়ে বিআইডব্লিটিএ-এর প্রকৌশলীদের ওপর ক্ষোভ দেখান প্রতিমন্ত্রী। পরে প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে ফেরির বদলে লঞ্চ সার্ভিস উদ্বোধন করানো হয়। প্রথমে দুটি এবং পরে ছয়টি লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও নাব্যতা সংকটে তাও কিছুদিন পর চলেনি। 

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ড্রেজিংয়ের সময় বালু দূরে না ফেলে নদীতেই ফেলা হয়। এছাড়া, ‘লোক দেখানো’ নামমাত্র নদী ড্রেজিং করে অর্থ লুটপাট করায় নৌপথটিতে একদিনের জন্যও ফেরি চালানো যায়নি। শুধু শুধু জনগণের টাকা অপচয় হয়েছে। এই ফেরি টার্মিনাল কোনো উপকারেই আসেনি। এখন কোটি কোটি টাকার স্থাপনা অলস পড়ে আছে। 

সরেজমিনে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাশীঘাট ফেরি টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, ‌চারপাশে সুনসান নীরবতা। সেখানে যাত্রীদের জন্য আধুনিক বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ, খাবার হোটেল ও আনসার ব্যারাকসহ কিছু নান্দনিক স্থাপনা রয়েছে। এর সবকিছুই ছিল বন্ধ। 

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ফুটানি বাজার (বাহাদুরাবাদ ঘাট) যেতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় চাকরি করি। জামালপুরে শ্বশুর বাড়ি হয়ে ঢাকা যাব। আগে কয়েকটি ছোট লঞ্চ চলাচল করেছিল। সেগুলো এখন বন্ধ। এ কারণে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় নদী পার হতে হচ্ছে।’

স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, বালাসীঘাট থেকে নদীপথে ফেরি সার্ভিস চালু হলে অল্প সময়ে ও অল্প খরচে আমরা ঢাকায় মালামাল আনা নেওয়া করতে পারতাম। প্রকল্পটি সফল হলে এলাকায় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতো। শুধু শুধু সরকারের এতগুলো টাকার অপচয় হয়েছে।

বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরি সার্ভিস চালু করা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসা গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের আট জেলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন হবে, এজন্যই দাবি তুলেছিলাম। কাজও শুরু হলো। প্রায় দেড় শ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়ে শুধু আলিশান ফেরিঘাট  টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নাব্য সংকট দূর করতে লোক দেখানো ড্রেজিং করা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। আসলে এ প্রকল্প গ্রহণই করা হয়েছিল লুটপাটের জন্য।’ 

প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডাব্লিউটিএ-এর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই প্রকল্পের লক্ষ্য ভালো ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নাব্যতা সৃষ্টি হবে জানার পরেও শুধু প্রকল্প ব্যয় বাড়াতেই এটা করা হয়। অথচ এই নৌ রুট বালাসীঘাট থেকে সানন্দাবাড়ি হয়ে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত করা হলে পথের দূরত্ব হতো মাত্র ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার। বাহাদুরাবাদ এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য তখন তার এলাকা ছাড়া এটা করতে দেননি। জামালপুরের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমও ছিলেন এই ১০ কিলোমিটারের বিরুদ্ধে। ব্যয় বাড়াতে এবং এসব অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে এত কোটি টাকার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুধু শুধু সরকারের এতগুলো টাকা গচ্ছা গেছে।’ 

বিআইডাব্লিউটিএ-এর প্রকৌশল বিভাগের প্রধান (ড্রেজিং) রাকিবুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

প্রায় দেড় শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটিএ-এর বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনাল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক নিজাম উদ্দীন পাঠান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দীর্ঘপথ এবং নাব্যতা সংকটের কারণে ফেরি সার্ভিস চালু করা যায়নি।’ এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানিয়ে তিনি ফোন সংযোগ কেটে দেন।

মাসুদ/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়