ঢাকা     বুধবার   ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ২২ ১৪৩১

কলার ছত্রাকনাশক ফুলকপিতে ব্যবহারে কৃষকের সর্বনাশ

রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৩, ৬ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১১:২৪, ৬ নভেম্বর ২০২৪
কলার ছত্রাকনাশক ফুলকপিতে ব্যবহারে কৃষকের সর্বনাশ

একটি ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পর রাজশাহীর কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। খেতের ফুলকপির গাছের কাণ্ড পচে সব গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। এ নিয়ে সোমবার জেলার দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া, গগনবাড়িয়া ও সাকোয়া গ্রামের ১৩ জন কৃষক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তারা ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন।

অভিযোগ পেয়ে ইউএনও সাবরিনা শারমিন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা পারভীন লাবনীকে তদন্তের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) কৃষি কর্মকর্তা সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করেছেন। এর আগেই ওই ছত্রাকনাশক বাজারজাতকারী কোম্পানি এলাকার দোকান থেকে পণ্যটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কৃষকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই কীটনাশক কোম্পানি কালক্ষেপণ করেছে। তাই তারা অভিযোগ করেছেন। 

ইউএনওর কাছে যেসব কৃষক অভিযোগ করেছেন তারা হলেন- শফি কামাল, হযরত আলী, মো. ছেকেন্দার, মন্টু, লাল্টু, আজিবর, কামরুল, জারজিদ, রবিউল, ছাতারুল, আতাউর, শহিদুল ও হাসান। তাদের মোট ৪৬৯ শতক জমির ফুলকপি নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।

 

এরা সবাই গগনবাড়িয়া বাজারের মাহামুদা এন্টার প্রাইজ নামের একটি কীটনাশকের দোকান থেকে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ‘নিউজিম’ নামক একটি ছত্রাকনাশক পাউডার কিনে জমিতে স্প্রে করেছিলেন। এটি বাজারজাত করেছে ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে লেখা আছে চীনের জিয়াংসু লাফেং বায়োকেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। ৫০০ গ্রামের প্যাকেট ৫০০ টাকায় কিনে এই ওষুধ স্প্রে করেছিলেন কৃষকেরা। 

কৃষকেরা বলছেন, এই ছত্রাকনাশক আসলে কলায় ব্যবহারের জন্য। কিন্তু বিক্রেতা ফুলকপির জন্য দিয়েছিলেন। এতে তাদের সর্বনাশ হয়েছে। কৃষকেরা জানান, এই ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পর গাছ মরতে শুরু করলে তারা এটির বিক্রেতা ছাতাহার আলীকে অবহিত করেন। ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোতালেব হোসেনকেও জানান। কিন্তু মোতালেব বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি। আর বিক্রেতা ছাতাহার আলী এবং ব্লেসিং এগ্রোভেটের রাজশাহীর আরএসএম জহুরুল হক কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপণ করেন। এরমধ্যেই বাজার থেকে ওই নিউজিম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তারা ইউএনওর কাছে অভিযোগ করেন। 

চুনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক শফি কামাল জানান, গত ১৬ অক্টোবর তিনি তার তিন বিঘা জমিতে এই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেন। একদিন পর লক্ষ্য করেন, গাছের রঙ হলুদ হলুদ লাগছে। ধীরে ধীরে হলদে রঙ বাড়তে থাকে। তিনদিন পর গাছের কাণ্ড পচে খসে পড়তে শুরু করে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাতজন কৃষক বিক্রেতাকে জানালে তিনি প্রথমে পাত্তাই দেননি। এ জন্য তারা অন্য লালশাক ও ঘাসে পরীক্ষামূলক এই ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। তাতে দেখা যায়, লালশাক ও ঘাসও পচে মরে গেছে। এরপর তারা ক্ষতিপূরণের জন্য চাপ দেন। 

শফি কামাল বলেন, ‘প্রথমে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেয় কোম্পানির লোকজন ও ডিলার। কিন্তু সময় চলে যায়। ওরা শুধু ঘুরায়। এরপর দোকান থেকে সব নিউজিম তুলে নেয় কোম্পানি। এখন ডিলার বলছে, কোন সমস্যা নিউজিমে ছিল না। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না।’ 

কৃষক সেকেন্দার আলী বলেন, ‘আমার ২ বিঘা ৩ কাঠা জমির ফুলকপি পচে নষ্ট হয়ে গেছে। জমি পরিষ্কার করতে একটা গাছেও হাঁসুয়ার কোপ মারা লাগবে না। সব পচে শেষ। প্রতিবছর আমি বিঘায় থেকে আড়াই-তিন লাখ টাকার কপি বিক্রি করি। এবার সব লস। ক্ষতিপূরণ না পেলে বিষ খেয়ে মরা ছাড়া কোন উপায় নাই। বিষ খাওয়ার টাকাটা যেন কোম্পানি দেয়।’ 

আরেক কৃষক হযরত আলী বলেন, ‘আমার ২৫ কাঠা জমিতে ফুলকপি ছিল। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন লাখ টাকা। আমি ছত্রাকনাশক স্প্রে করি ১২ অক্টোবর। ১৬ তারিখে বুঝি যে গাছে সমস্যা। ২১ তারিখে অভিযোগ জানাই ডিলারের কাছে। তাতে লাভ না হলে ইউএনওকে জানাই।’

 

হযরত আলী যখন কথা বলছিলেন তখন তার জমিতেই ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা পারভীন লাবনী। তিনি বলেন, ‘সমস্যা কিছুদিন আগেই হয়েছে। কিন্তু উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমাকে জানাননি। এটা আসলে কলায় ব্যবহারের ছত্রাকনাশক। ফুলকপির জন্য কেন দেওয়া হয়েছে তা জানি না। বিষয়টি জানার পরই আমি এসেছি। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটাই দেখলাম। ক্ষতি কী কারণে হয়েছে সেটা পরীক্ষা না করে বলতে পারব না। নিউজিমেই সমস্যা কি না জানতে আজ ভাল কিছু গাছেও স্প্রে করালাম। এটা দুদিন পর এসে আবার দেখব। কৃষক এবং দোকান থেকে নিউজিমের নমুনা সংগ্রহ করলাম। এগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখব।’ 

দুর্গাপুরের ইউএনও সাবরিনা শারমিন বলেন, ‘কৃষকেরা আমার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানিয়েছি। তাকে মাঠে যেতে বলেছি। তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলেছি। তিনি মাঠে গিয়েছেন। তদন্তে যদি দেখা যায় নিউজিমেই সমস্যা ছিল, তাহলে কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্ষতিপূরণও আদায় করা হবে।’ 

নিউজিম বিক্রেতা গগনবাড়িয়া বাজারের মাহামুদা এন্টার প্রাইজের সত্ত্বাধিকারী ছাতাহার আলী বলেন, ‘সমস্যা জানানোর পর কোম্পানি সব নিউজিম নিয়ে চলে গেছে। আর বিক্রি করছি না।’ 

তবে নিউজিমে কোন সমস্যা নেই দাবি করেছেন বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ব্লেসিং এগ্রোভেটের রাজশাহীর আরএসএম জহুরুল হক। তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর অন্য জায়গাতেও আমরা একই নিউজিম বিক্রি করেছি। কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। দুর্গাপুরে কেন তা বলতে পারব না।’ 

ব্লেসিং এগ্রোভেটের প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট অফিসার মো. মাসুম প্রথমে দাবি করেন নিউজিমের কোন সমস্যা হয়নি। দুর্গাপুরের কৃষকদের বিষয়ে জানালে তিনি বলেন, ‘সেইম প্রোডাক্ট আমরা সেইম ডোজে রংপুরে অ্যাপ্লাই করেছি। সেখানে কোন প্রবলেম আমরা পাইনি। তাই আমাদের প্রোডাক্টের কোন সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য কারণে হতে পারে।’

কেয়া/ইমন


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়