ক্যাপসিকাম চাষে ২৯ কৃষকের স্বপ্ন
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
একটি জমিতে গ্রামের ২৯ জন কৃষক মিলে কাজ করছে। কেউ জমি প্রস্তুতের কাজ করছে, কেউবা সার মিশিয়ে দিচ্ছে, আবার কেউ নালা করছে, কেউ বেড তৈরি করছে আবার কেউবা বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। সেই সাথে কেউ ধরেছে মনের সুখে গান। মিলে মিশে যেন সবাই একাকার হয়ে কাজ করছে মাঠে। দেখলে মনে হবে যে শ্রমিকেরা মাঠে কাজ করছে, কিন্তু না তারা কেউ এই জমির শ্রমিক না।
কেউ টাকার বিনিময়ে কাজ করছে না এখানে। আধুনিক পদ্ধতিতে উচ্চমূল্য সবজি ক্যাপসিকাম চাষ করার জন্য সবাই এসে এখানে স্বপ্ন বুনছে। বাণিজ্যিকভাবে ক্যাপসিকাম চাষ করা লাভজনক হলেও গরীব কৃষকদের জন্য এটি চাষ মোটেও সহজ নয়। ব্যয়বহুল এ চাষকে সহজ করতে তারা একটি সমিতির মাধ্যমে কাজ করছেন। আর উচ্চমূল্য এ ক্যাপসিকাম চাষে তাদের সহযোগিতা করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প। কৃষকদের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পাশাপাশি, প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এই কৃষি প্রকল্পটি। যার ফলে বেশ আগ্রহ নিয়ে খুশি মনে মিলে মিশে কাজ করছেন কৃষকরা।
বলছিলাম কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের নিয়ামতবাড়ীয়া গ্রামের কৃষকদের কথা। তারা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তাদের ক্যাপসিকামের জমি নিয়ে। ইতিমধ্যে তারা জমি প্রস্তুত করে রোপণ করেছেন চারা। প্রায় ৬ বিঘা জমিতে তারা একসাথে ক্যাপসিকামের চারা রোপণ করেছেন। আরো ৪ বিঘা জমি চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
কৃষক তরিকুল ইসলাম জানান, ক্যাপসিকাম এর চাষ কিভাবে করে সেটি আমরা জানি না। তবে শুনেছি এর জন্য অনেক খরচ করা লাগে। তাই আমরা সমিতির মাধ্যম দিয়ে এবারই প্রথম ক্যাপসিকাম চাষ করছি। আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ক্যাপসিকাম চাষের উপরে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। এবং কৃষি অফিসের লোকজন এসে আমাদের কিভাবে কি করতে হবে সেটি দেখিয়ে দিচ্ছে।
আতিয়ার রহমান নামের আরেকজন কৃষক জানান, গতবছর কিছু জমিতে ক্যাপসিকামের আবাদ করেছিলাম। অল্প হওয়ার কারণে জেলার বাইরে বিক্রি করার সমস্যা হয়েছিলো। তাই এবার একসাথে মিলে আমরা বড় পরিসরে ক্যাপসিকামের আবাদ করছি। যাতে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভালো দামে বিক্রি করতে পারি।
লিখন নামের একজন কৃষক জানান, একার পক্ষে ক্যাপসিকাম চাষ করা অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমরা এলাকার কৃষকদের নিয়ে একটা সমিতির মাধ্যম দিয়ে এখানে ক্যাপসিকাম চাষ করছি। আমরা মাটি প্রস্তুত থেকে শুরু করে সার দেওয়া, বেড তৈরি, মালচিং দেওয়া, চারা রোপণ ও পরিচর্যা করার ক্ষেত্রে সকলে মিলে করি। এতে আমাদের সময় অপচয় কম হয় এবং শ্রমিক খরচ লাগে না। এখানে প্রায় ২৯ জন কাজ করে। এরা কেউই শ্রমিক না সবাই ক্যাপসিকামের অংশিদার। এর ফলে সবাই এ ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে জানতে পারছে। যাতে পরবর্তীতে তারা নিজেরাও এ চাষ করতে পারে।
তিনি আরও জানান, ক্যাপসিকাম একটি উচ্চমূল্য সবজি। এর বাজার দর বেশ ভালো থাকে। তবে অল্প চাষ হলে বিক্রিতে সমস্যা হয়। এজন্য আমরা সবাই মিলে একসাথে চাষ করছি।
একই এলাকার কৃষকরা নিজেদের অর্থায়নে অল্প কিছু কিছু করে সঞ্চয় জমিয়ে “জঙ্গলী আধুনিক কৃষি সমবায় সমিতি” নামের একটি সমিতির মাধ্যমে এ চাষ করছে।
সমিতির সভাপতি ইলিয়াস খাঁন জানান, আমরা ২৯ জন কৃষক মিলে এই সমিতিতে সঞ্চয় করি। সেই টাকা দিয়ে আমরা জমি বর্গা নিয়ে এবার এ ক্যাপসিকামের চাষ শুরু করেছি। উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে আমরা যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ক্যাপসিকাম চাষের উপরে ৩ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। সেই সাথে প্রকল্প থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। যার মাধ্যমে এ কাজে আমরা বেশি আগ্রহী হয়েছি। যদি এবার ক্যাপসিকাম ভালো হয় তাহলে আরো বিস্তীর্ণ এলাকায় আমরা ক্যাপসিকামের আবাদ করবো।
স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ক্যাপসিকাম যেহেতু এই এলাকার জন্য নতুন একটি ফসল। এবং কৃষকরা এটির চাষ সম্পর্কে ততটা অভিজ্ঞ না। ভালোভাবে চাষের জন্য আমরা সার্বক্ষণিক তাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া তাদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণও দিচ্ছি এই ক্যাপসিকাম চাষে।
কুমারখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, ক্যাপপিসাম খুবই পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর সবজি। সবজি হিসাবে এবং সালাদ হিসাবেও এটি খাওয়া যায়। এর বাজার মূল্য অন্য সবজির তুলনায় অনেক বেশি। কৃষকরা এটি চাষ করে বেশ লাভবান হতে পারে। গতবছর কুমারখালীতে ক্যাপসিকাম চাষ করে সবুজ নামের এক যুবক বেশ লাভবান হওয়ায় এলাকার অনেক কৃষক এ চাষে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে এ ক্যাপসিকাম চাষে উদ্বুদ্ধ করছি।
যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, কৃষকরা যাতে নিরাপদ উপায়ে ক্যাপসিকাম চাষ করতে পারে এজন্য আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। সেই সাথে মাঠ পর্যায়ে আমরা ক্যাপসিকাম চাষের জন্য প্রদর্শনী বাস্তবায়ন ও মাঠ দিবস করছি। এছাড়া কৃষকরা যাতে সঠিক মূল্য পায় এজন্য আমরা সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজার সংযোগের ব্যবস্থা করছি।
তিনি আরও জানান, আমরা বিভিন্ন সবজি ও ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমিয়ে মূল্য সংযোজন করার জন্য কৃষক পর্যায়ে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কাজ করছি।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান জানান, বর্তমানে কৃষকরা লাভজনক কৃষির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন ক্যাপসিকাম চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তাই কৃষকরা মাঠে জমি তৈরি ও চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছে। কুষ্টিয়া জেলার জন্য ক্যাপসিকাম চাষ একটি সম্ভাবনাময় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা/কাঞ্চন/ইমন