ধানের গোলা এখন কেবলই স্মৃতি
দিনাজপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
ঐতিহ্যের বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধানের গোলা।
গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান এখন শুধুই স্মৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সেই ধানের গোলাঘর। আধুনিক যুগে তার জায়গা নিয়েছে বিশেষ সুবিধা সম্পন্ন গুদাম ঘর। তবে বাপ-দাদার স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে এখনও এই গোলা বাড়িতে রেখে দিয়েছেন কেউ কেউ।
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদাড় ইউনিয়নের বৈগ্রাম গ্রামের কৃষক সাব্বির হোসেন সবুজের বাড়ির খোলায় আজও দাঁড়িয়ে আছে এই ধানের গোলাঘর। প্রায় ৫০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিলো ধানের গোলাটি। এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় জায়গা দখল করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ১৫ বছর ধরে কোনো কাজেই আসে না গোলাঘরটি।
এক সময়ের গ্রামবাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কৃষিক্ষেত ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা আধুনিক যুগের ইট, বালু আর সিমেন্টের তৈরি গুদামের কারণে হারিয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জে প্রায় কৃষকের বাড়িতে ধান মজুদ রাখার জন্য বাঁশ, বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি করা হতো গোলা। পরে গোলাঘরের গায়ে ভেতরে ও বাহিরে বেশ পুরু করে লাগানো হতো মাটির আস্তরণ। গোলা ঘরের প্রবেশ পথ রাখা হতো উঁচুতে, যাতে সহজেই চোর ধান চুরি না করতে পারে।
এছাড়াও অতিতে সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার কয়টি ধানের গোলা আছে এই হিসেবে। শুধু তাই নয় কন্যা ও বর পক্ষের বাড়ির ধানের গোলার খবর নিতো উভয় পক্ষের লোকজন, যা এখন শুধু কল্পকাহিনী। ধানের গোলা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। তারা বাড়িতে এসে বাঁশ দিয়ে তৈরি করত ধানের গোলা। কাজ না থাকায় এখন তারা ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ধানের গোলাঘর এখন শুধুই স্মৃতি।
বৈগ্রাম গ্রামের ৮০ বছর বয়সী লোকমান হোসেন বলেন, ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট আর রডের আবিষ্কার হওয়াতে অতীতের অনেক জিনিস এখন অচল হয়ে গেছে। আমাদের সময় ভাদ্র মাসে জমিতে পানি থাকতো। পানির মধ্যে আউশধান কেটে ভিজা ধান গোলায় রাখতাম। ভিজা ধান গোলায় শুকিয়ে যেতে। আবার ওই ধানের চাল অনেক শক্ত হতো। ভাত খেতেও স্বাদ পেতাম। এখন এসব আর হয় না, আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব হারিয়ে যাচ্ছে।
৭৬ বছর বয়সী মরিয়ম বিবি বলেন, আমাদের সময় প্রায় সব বাড়িতে ধানের গোলাঘর ছিলো। সারা বছর গোলা থেকে ধান বের করে তা সিদ্ধ-শুকান করে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল বেড় করতাম। এখন আর তা করতে হয় না। মিল-কারখানা আর চাতালে এসব কাজ হয়। ওই সময় বড় বড় গৃহস্থদের বাড়িতে বড় বড় ধানের গোলাঘর থাকতো। আমারও বিয়ে দিয়েছিলো পরিবারের লোকজন বড় গোলাঘর দেখে।
কৃষক সাব্বির হোসেন সবুজ বলেন, আমাদের এই গোলাঘর এর বয়স প্রায় ৫০ বছর হবে। আমি ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, বাবা-মা এই গোলাঘর বোঝাই করে ধান রাখতো। সারা বছর গোলায় ধান থাকতো। প্রায় ১৫ বছর ধরে গোলাঘরটি আর ব্যবহার করা হয় না। কালের সাক্ষী হিসেবে আজও আমরা ধানের গোলাঘর রেখে দিয়েছি। মাঝে-মধ্যে অনেকেই গোলাঘরটি দেখতে আসে। যদিও আর কিছুদিনের মধ্যে গোলাঘরটি ভেঙে যেতে পারে।
ঢাকা/মোসলেম/ইমন