মা নেই, বাবাও গ্রেপ্তার
তিন বোন নিয়ে অথৈ সাগরে শিশু সাজ্জাদ
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
দুই সন্তানকে জন্ম দিয়ে মারা গেছেন স্ত্রী। সদ্যজাত দুই সন্তানকে নিয়ে দুই চোখে যখন আঁধার দেখছিলেন জামাল মিয়া, ঠিক তখনি রাজনৈতিক হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হন।
মাকে হারায়ে ও বাবা গ্রেপ্তার হওয়ায় সদ্যজাত দুই বোনকে নিয়ে অথৈ সাগরে ছোট দুই ভাই-বোন।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার জামাল মিয়া রাজনীতি করেন না, নেই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। তবে পুলিশ বলছে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হত্যায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দ্রুত তদন্ত শেষে জামালকে মুক্তি দেওয়ার দাবি পরিবার ও স্থানীয়দের।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) কোটালীপাড়া উপজেলার চিত্রাপাড়া গ্রামে গেলে দেখা মেলে জামাল মিয়ার ১৩ বছরের ছেলে সাজ্জাদ মিয়ার। সাজ্জাদ স্থানীয় এম এম খান উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তার বোন ফারিয়ার বয়স ৭ বছর। সদ্য দুই বোনের জন্ম হওয়ার ৬ দিনের মাথায় মারা যান মা সাথি বেগম। মাকে হারিয়ে যখন বাবাই একমাত্র ভরসা। মাকে হারানোর কান্নার জল চোখ থেকে শুকাতে না শুকাতেই ছোট্ট সাজ্জাদের সামনে বাবাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
গত শুক্রবার (৮ নভেম্বর) রাতে বাড়ি থেকে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদার হত্যা মামলায় জামাল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর এলাকাবাসী পুলিশের দ্বারস্থ হলেও ছাড়াতে পারেনি। পরদিন শনিবার তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকে শিশু সাজ্জাদ ছোট তিন বোনকে নিয়ে অথৈই সাগরে ভাসছে। সদ্যজাত দুই বোনকে দেখাশোনা করছেন নানী ও দাদী। আর এলাকাবাসীর সহযোগীতায় চলছে সাজ্জাদের পরিবার।
পরিবারের অভিযোগ, কোনো রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিক মামলায় জামালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে ছাড়ানোর জন্য চষ্টা করা হলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করা হয় বলেও জানান তারা।
সাজ্জাদ বলে, ‘এক মাস আগে আমাদের মা মারা গেছেন। এখন পুলিশ বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। বাবা এখন জেলে। ঘরে অসুস্থ দাদি। আমাদের দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই। আত্মীয়স্বজন যা দিচ্ছে তাই দিয়ে আমাদের সংসার চলছে। এখন আমার ও আমার বোনের লেখাপাড়া বন্ধ হতে বসেছে। আমরা এখন কীভাবে বাঁচব? কয়েক দিন পরই আমার বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। আমার স্কুলের বেতন ও পরীক্ষার ফি কে দেবে? আমার এক মাস বয়সী দুই বোনের দুধের টাকা কে দেবে? আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই।’
জামাল মিয়ার ভাই মনির মিয়া বলেন, ‘আমার ভাইয়ের প্রথম সন্তান সাজ্জাদ এম এম খান উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। দ্বিতীয় সন্তান ফারিয়া চিত্রাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। এ ছাড়া এক মাস বয়সী দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এই দুই কন্যা সন্তান জন্মের ছয় দিনের মাথায় জামালের স্ত্রী সাথী বেগম মারা যায়। আমার বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা আমার ভাই জামালই করতো। এখন জামালের চার শিশু সন্তান ও বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করার কেউ নেই। আমার ভাই বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নেই। এক সময় সে আমতলী ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলো। পুলিশ কী কারণে আমার ভাইকে ধরে নিয়ে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে তা আমাদের জানা নেই।’
প্রতিবেশী কাইয়ুম মিয়া বলেন, ‘জামাল কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নাই। তারপরেও তাকে কেন একটি রাজনৈতিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হলো? জামালের অবুঝ চার শিশু সন্তানের দায়িত্ব এখন কে নিবে? জামালকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অমানবিক। তাই এই চার শিশুসন্তান ও অসুস্থ বৃদ্ধা মায়ের দিকে তাকিয়ে আমরা এলাকাবাসী জামালের মুক্তির দাবি জানাই।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য সেলিম মিয়া বলেন, ‘জামাল মিয়াকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর পরিবারটি এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। সদ্য জমজ শিশুর তিন দিন পর পর দুধ প্রয়োজন হয়। জামাল মিয়া গ্রেপ্তার হওয়ায় শিশু দুটির জন্য দুধ কিনতে পারছে না। জামাল মিয়ার বড় ছেলে ও বড় মেয়েটির স্কুলে যাওয়া এখন বন্ধের পথে। আমরা মিথ্যা মামলা থেকে জামাল মিয়ার মুক্তি চাই।’
কোটালীপাড়া উপজেলা জামায়েত ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বলেন, ‘জামাল মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এখন এটা আদালতের বিষয়। আমরা পরিবারটির পাশে দাঁড়াবো এবং আইনি সকল প্রকার সহযোগীতা করবো।’
কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জামাল মিয়া ঢাকার তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন বলে আমরা জেনেছি। তাই তাকে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তার দুটি সদ্যজাত সন্তানসহ ছোট ৪টি সন্তান রয়েছে বলে জানা ছিলো না।’
ঢাকা/বাদল/টিপু