ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

মেঘনার চরে কৃষি বিপ্লব 

জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৫:৫৯, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪
মেঘনার চরে কৃষি বিপ্লব 

আগে গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত চর মেঘা এখন ফুল-ফসলে পরিপূর্ণ

লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। আগে যেখানে হাতেগোনা কয়েকটি ফসল চাষ হতো, সেখানে এখন সবজিসহ প্রায় সব ধরনের ফসল চাষ হচ্ছে। অনেক অনাবাদি জমি এসেছে চাষাবাদের আওতায়। কৃষি নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করা চরের মানুষ।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রমনীমোহন ইউনিয়নের মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট থেকে পশ্চিমে নদীর মাঝখানে অবস্থিত চর মেঘায় গিয়ে দেখা গেছে, আগে গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত এ চর এখন ফুল-ফসলে পরিপূর্ণ। প্রায় ২০ বছর ধরে স্থানীয় কৃষকরা চরের উর্বর পলিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করছেন। 

প্রথমদিকে এ চরে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হতো সয়াবিন, এরপর ধান। এখন ধান ও সয়াবিনের পাশাপাশি শসা, করলাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। বছরে ছয় মাস এ চরে চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা। 

এখানে উৎপাদিত সবজির প্রায় ৯০ শতাংশ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ চর যেমন স্থানীয়দের খাদ্যের সংস্থান করছে, তেমনই অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করছে।

তবে, ওই চরের কৃষকদের অভিযোগ, চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ থেকে কোনো সহযোগিতা তো দূরের কথা, পরামর্শও পান না তারা। কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর কেউ কখনো আসেন না তাদের কাছে। এখানকার উৎপাদিত ফসলের হিসাবও কখনো নেওয়া হয় না। কৃষকরা নিজেরাই নানা সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করেন। 

চরের কৃষকরা অনেক ফসল ফলানোর চেষ্টা করলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ক্ষতির শিকার হতে হয় অনেক সময়। কৃষিপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে বেপারিদের বেঁধে দেওয়া মূল্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় তাদের। এতে অনেকাংশে নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা। 

চর মেঘার কৃষকদের দাবি, কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সুনজর পেলে চরের মাটিতে আরও বেশি ফসল ফলানো সম্ভব। 

কৃষক জামাল হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেছেন, “এ চরে ধানের পাশাপাশি শসা, খিরা, করলা, লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গা ও তরীসহ নানা জাতের সবজির ভালো ফলন হয়। বাণিজ্যিক চাষাবাদে মোটা অংকের অর্থ প্রয়োজন। সব সময় টাকা পকেটে রাখতে হয়। কিন্তু, আমরা কোনো ঋণ পাই না। ঠিকমতো চাষাবাদ করতে পারলে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে, ভালো লাভ হয়। গত মাসে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে অন্তত ৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে কৃষি অফিসাররা আছেন কি না, তা জানি না। গত ৩ বছরে আমি কাউকে দেখিনি।”

আরেক কৃষক আবু তাহের বলেন, “ঝড়বৃষ্টি বা জোয়ার উঠলে কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আবার নতুন করে চাষাবাদ করি। তবে, সব মিলিয়ে লাভ হয়। তবে, কৃষি বিভাগ থেকে কখনো কেউ আমাদের দুটো সার বা বীজ দেয়নি।”

চরের কৃষিশ্রমিক রিয়াজ, ফরিদা বেগম ও নাছরিন বলেন, “চর মেঘায় চাষাবাদ শুরুর পর অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরে ছয় মাস চরে কাজ থাকে। আমরা মাসিক ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে নিয়োজিত আছি। চরেই থাকি, চরেই কাজকর্ম করি।”

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, “চরের মাটির গুণ ভালো। তাই, ফলন ভালো হয়। ১৫ বছর ধরে চরে ধান, সয়াবিন, সবজি চাষ করি। মাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে চরের ফসল তলিয়ে যায়। তখন ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। তবে, এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাই না।”

কলেজ শিক্ষার্থী মো. জিহাদ হোসেন বলেন, “চর মেঘার ফসল দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে চরের জমি এবং কৃষকরা ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু, কৃষিপণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে কৃষকদের ঠকতে হয়। তারা নায্যমূল্য পান না। পণ্য বাজারজাত করতে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন কৃষকরা।”

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেছেন, “চরের ১২ হাজার ৪০২ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। নদীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে কেন্দ্র করে কৃষি বিভাগ কিছু পরিকল্পনা করেছে। এখানে জোয়ার-ভাটার একটা প্রভাব আছে। তাই, ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে আমাদের কিছু প্রদর্শনী করা হয়েছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। মাঠ দিবসও করা হয়। চরের মাটি অত্যন্ত উর্বর। সেখানে সরিষা, ভুট্টা, বাদাম, তিল সম্ভাবনাময় ফসল। আমরা ব্যাপকভাবে এগুলো চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি।”

ঢাকা/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়