ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

সাভারে গুলিতে নিহত কুরমান শেখের স্ত্রীর কান্না থামছেই না

রবিউল আউয়াল, রাজবাড়ী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২১, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১১:২৮, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
সাভারে গুলিতে নিহত কুরমান শেখের স্ত্রীর কান্না থামছেই না

কুরমান শেখ

‘ছেলে-মেয়ে দুজনকে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন দেখতো মানুষটা। কী চাইল আর কী হয়ে গেল। আমি ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে এখন কোথায় দাঁড়াব।’- এভাবেই কেঁদে কেঁদে বিলাপ করছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকার সাভারে গুলিতে নিহত মুরগী ব্যবসায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধী কুরমান শেখের স্ত্রী শিল্পী বেগম। 

কুরমান শেখ রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের মৃত মেহের শেখের ছেলে। গত ২০ জুলাই শনিবার দুপুরে তিনি নিহত হন।

কুরমান শেখের পারিবারিক তথ্যানুযায়ী, ছয় ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন কুরমান শেখ। ২০ বছর আগে জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকার সাভারে যান তিনি। সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মুরগীর ব্যবসা করতেন। পাশেই তার সহোদর ভাই মোতালেব শেখ কাঁচামালের ব্যবসা করেন। সাভারের স্মরিণকায় স্ত্রী আর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন কুরমান শেখ। 

আরো পড়ুন:

ছেলে রমজান শেখ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিষয়ে সম্মান ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। মেয়ে মিতু আক্তার ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে বিবিএতে অধ্যয়নরত। স্বামীর মৃত্যুর পর শিল্পী বেগম দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কালুখালীর রতনদিয়ায় কুরমান শেখের বড় ভাই সাত্তার শেখের বাড়িতে বসবাস করছেন। সেখানেই কথা হয় শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। শিল্পী বেগম এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার কান্না থামছেই না। ছেলে রমজান আর মেয়ে মিতু শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কে কাকে দেবে সান্ত্বনা।

কুরমান শেখের মেয়ে মিতু আক্তার বলেন, “ঘটনার দিন দুপুর ১টার কিছু আগে বাবাকে ফোন করে বলি, প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো। হ্যাঁ মা আমি এখনই আসি বলেই বাবা ফোন রেখে দেন। তার কিছুক্ষণ পরই খবর পাই বাবার গুলি লেগেছে। বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করার স্বপ্ন ছিল বাবার। কত কষ্ট করে বাবা আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। এখন আমাদের কে পড়াশোনা করাবে? বাবাকে ছাড়া একটি দিন কল্পনা করা যায়না। বাবার মৃত্যুতে পৃথিবীটা বড় শূন্য মনে হচ্ছে।”

ছেলে রমজান শেখ জানান, তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ঘটনার দিন দুপুর দেড়টার দিকে খবর পান তার বাবার গুলি লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন বাবার নিথর দেহ পড়ে আছে। তার গলায় ও পায়ে গুলি লেগেছে। শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন। তার বাবা অচেতন। কেউ কেউ বলেন, তার বাবা মারা গেছে। শরীর তখনও গরম ছিল। একারণে তিনি কাছে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানালে এনাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তাররা দেখে মৃত ঘোষণা করেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রমজান শেখ বলেন, “সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গোলাগুলি দেখে বাবা দোকান বন্ধ করে বাড়িতে আসছিলেন। অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ হওয়ায় একটি বরফ কলে আশ্রয় নেন। সেখানে আরও লোক ছিল। পুলিশ সেখানে ঢুকে গুলি করে। রমজান বলেন, আমার বাবা আমাকে কখনও ধমক দেননি। আমাকে বলতেন অনেক বড় হতে হবে। বাবার মুরগীর ব্যবসার উপর চলতো দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ আর সংসার। পড়াশোনার জন্য যখন যা প্রয়োজন তা কষ্ট হলেও দিতেন। কখনও বুঝতে দিতেন না। আমি আমার বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলাম।”

শিল্পী বেগমের এখন কান্নাই যেন সম্বল। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ছেলে-মেয়েকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন ছিল মানুষটার। কী চাইল আর কী হয়ে গেল। আমার এখন কী হবে? ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাব কেমন করে। থাকবই বা কোথায়। মিছিল মিটিংয়ে গিয়ে মারা গেলে নিজেকে বুঝ দিতে পারতাম। এভাবে কেন মারল আমার স্বামীকে।” 

তিনি বলেন, “আমার ছেলে খুব মেধাবী। এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা করানোর জন্য খুব কষ্ট করতেন তিনি। কখনও অভাব বুঝতে দেননি।”

কুরমান শেখের বড় ভাই সাত্তার শেখ জানান, তার ভাই কুরমান ছোটকালে সাঁকো থেকে পড়ে আহত হন। তারপর থেকে ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না। বিগত ২০ বছর ধরে সাভারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। সেখানেই ছিল তাদের সংসার। ২০ জুলাই দুপুরে তার অপর সহোদর ভাই মোতালেব ফোন করে বলেন, কুরমান মনে হয় আর নেই। শুনেই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আগের দিন শুক্রবার কুরমান তাকে ফোন করে মা-ভাইদের খোঁজ খবর নিয়েছিল। তার মা পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙেছে। অপারেশন করাতে হয়েছে। তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে অনেক পড়ে নানা কৌশলে। যাতে তার মা ভেঙে না পড়েন। 

তিনি বলেন, “বিধাতার কী নির্মম পরিহাস যেদিন মাকে অপারেশন করিয়ে বাড়ি নিয়ে আসলাম সেদিনই অ্যাম্বুলেন্সে আসলো ভাইয়ের লাশ। কুরমানের পরিবারটি গভীর সমুদ্রে পড়েছে।” 

ঢাকা/টিপু

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়