সার সংকটে উত্তরের আলু চাষিরা
শিরিন সুলতানা কেয়া, রাজশাহী || রাইজিংবিডি.কম
আলু চাষের মৌসুমে চলমান বীজ সংকটের পাশাপাশি সারের ঘাটতি উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। কৃত্রিম সংকটের কারণে তাদের প্রতিবস্তা সারের জন্য অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। সাধারণ কৃষকেরা কৃত্রিম সংকটের জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং কৃষি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন।
যদিও কৃষি বিভাগ বলছে, একজন অপরজনকে দেখে মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার করছেন কৃষকেরা। ফলে সংকট বেড়েছে। তারা কৃষকদের সঙ্গে গ্রুপ মিটিং এবং ইয়ার্ড মিটিং করছেন এবং কৃষকদের সচেতন করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন যাতে পরবর্তীতে অনুমোদিত মাত্রার বেশি সার প্রয়োগ না হয়। অনুমোদিত মাত্রায় সার ব্যবহার করলে সংকট হবে না বলছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ১০৬ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যার মধ্যে ৭৯ লাখ টনই উৎপাদন হয়েছে রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে। ২০২৪-২৫ মৌসুমে শুধু রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ৩ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৯৮ লাখ ৫৫ হাজার টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কৃষকেরা জানান, প্রায় দুই বস্তা (১০০ কেজি) এমওপি (পটাশ), এক বস্তা (৫০ কেজি) ফসফেট (ডিএপি) এবং এক বস্তা টিএসপি সার প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষের শুরুতেই তারা ব্যবহার করেন। এই সার চাহিদামত পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও কৃষিবিদেরা বলছেন, এক বিঘা আলু চাষে এত বেশি সারের কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়তি সার ব্যবহার করছেন কৃষকেরা।
রাজশাহীর তানোরের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, “আমাদের কৃষি জমিতে কখন এবং কতটা সার প্রয়োগ করতে হবে তা আমরা আসলে জানি না। বর্তমানে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করি। পাশের কৃষক কতটা দিচ্ছে দেখি। সে অনুযায়ী আমরাও দিই।”
তিনি আরো বলেন, “শুরুতে একবার সার দিয়েছি। আলুর পাতা গজালে আবার অল্প পরিমাণ সার দিব।”
একই উপজেলার আরেক কৃষক মোস্তাকিন ইসলাম বলেন, “প্রতি বিঘা জমিতে আলু বীজ লাগানোর আগে আমরা দুই বস্তা এমওপি, দেড় বস্তা ডিএপি এবং আধা বস্তা টিএসপি প্রয়োগ করেছি।”
তিনি আরো বলেন, “যত বেশি সার ব্যবহার করব, তত বেশি আলুর ফলন পাব।”
আলু চাষের জন্য তাদের জমিতে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে সে বিষয়ে কৃষি বিভাগের কেউ যোগাযোগ করেছেন কি না জানতে চাইলে মোস্তাকিন ইসলাম বলেন, “আমাদের কেউ কোনো নির্দেশনা দেয়নি।”
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, “আমিও প্রতি বিঘা জমিতে দুই বস্তা এমওপি এবং এক বস্তা টিএসপি ও ডিএপি প্রয়োগ করেছি।”
তিনি আরো বলেন, “যদিও বেশি ফলন পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের এলাকার কৃষকেরা তাদের আলু খেতে সার প্রয়োগে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।”
বগুড়ার শেরপুরের কুসুম্বী উপজেলার কৃষক আবু সাঈদ বলেন, “প্রতি বিঘা আলু চাষের শুরুতে আমি এক বস্তা করে টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম এবং আধা বস্তা ইউরিয়া প্রয়োগ করেছি। আলুর পাতা বের হলে আরো এক বস্তা ডিএপি ব্যবহার করার পরিকল্পনা আছে।”
যদিও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বিঘা জমিতে এমওপি ও টিএসপি ২৪ কেজি করে এবং ডিএপির প্রস্তাবিত পরিমাণ ২০ কেজি। এর বেশি সার প্রয়োগ অপচয়।
রাজশাহীর একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “যদি কোনো কৃষক তাদের আলু খেতে টিএসপি প্রয়োগ করেন, তাহলে ডিএপি প্রয়োগ করার দরকার নেই। কারণ সেগুলো জেনেটিক্যালি ফসফেট। তারপরেও কৃষকেরা না বুঝে সব সারই প্রয়োগ করতে থাকেন। এতে তাদের তেমন কোনো লাভ হয় না।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক কাওসার আলী বলেন, “প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষের শুরুতে ২০ থেকে ২৫ কেজি এমওপি এবং টিএসপি বা ডিএপি যথেষ্ট। সচেতনতার অভাবে কৃষকরা অতিরিক্ত সার ব্যবহার করছেন, যা অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। এ কারণে কৃষকদের শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না, ফসলি জমির উপরের মাটিও নষ্ট হচ্ছে, ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে। সারেরও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।”
বাজারে সারের সংকট
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী জেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে ১৪ হাজার ৩৭৪ টন এমওপি, ২৫ হাজার ৬০০ টন ডিএপি এবং ৯ হাজার ২৮৬ টন টিএসপি বরাদ্দ করা হয়েছে। ডিসেম্বরে ৩১ হাজার ২৮৮ টন ডিএপি এবং ৯ হাজার ৮১৭ টন টিএসপি বরাদ্দ করা হবে।
কর্মকর্তারা জানান, কৃষক পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত এমওপি ১ হাজার টাকা, ডিএপি ১ হাজার ৫০ টাকা ও টিএসপি সারের দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা। রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া বাজারের একটি বিসিআইসি ডিলারের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত দামে সার বিক্রি হচ্ছে না। এখানে এমওপি ১ হাজার ১৮০ টাকা, ডিএপি ১ হাজার ৩০০ টাকা ও টিএসপি সার ১ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দোকানের কর্মচারী জানান, কৃষকদের চাহিদার বিপরীতে বিসিআইসি বরাদ্দ খুবই কম হওয়ায় তারা অন্য জায়গা থেকে সার সংগ্রহ করেছেন।
অন্য জায়গার ব্যাখ্যা দিয়ে ওই কর্মচারী বলেন, বিসিআইসি সব উপজেলার সব ডিলারকে সব ধরনের সার সমানভাবে বরাদ্দ দেয়। এখন দেখা যায়, কোনো উপজেলায় আলু চাষ হয় কম, কোনো উপজেলায় বেশি। যে উপজেলায় কম চাষ হয়, সেখানে সারের চাহিদা কম থাকে। তখন তারা ওইসব উপজেলা থেকে বাড়তি দামে সার সংগ্রহ করে এনে চাষিদের দিচ্ছেন।
এদিকে কম বরাদ্দের কারনে ডিলাররা প্রতি বস্তা সারের জন্য ২০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ কৃষকদের। রাজশাহীর তানোর উপজেলার আলু চাষি হাবিবুর রহমান বলেন, “আমার ১৫ বিঘা জমিতে আলুর বীজ লাগানোর আগে ৩০ বস্তা এমওপি, ১৫ বস্তা ডিএপি এবং ১৫ বস্তা টিএসপি সারের প্রয়োজন ছিল। বিসিআইসি ডিলারের দোকানে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যে মাত্র এক বস্তা এমওপি সারের ব্যবস্থা করতে পেরেছি।”
তিনি আরো বলেন, “আমি যেখান থেকে সার নিয়েছি সেই ডিলার প্রতি বস্তা ১ হাজার ২০০ টাকায় এমওপি বিক্রি করছেন। তিনি এটি অন্য উপজেলা থেকে সংগ্রহ করেছেন বলে দাবি করেছেন। ফলে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে ২০০ টাকা বেশি দিয়েই চাষিরা এমওপি কিনেছি। প্রয়োজন বলে চাষিরা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।”
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে সালমা বলেন, “আমরা মনিটরিংয়ের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, যাতে কোনো ডিলার কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতে না পারেন।”
তিনি আরো বলেন, “কেউ যদি আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করে তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
অতিরিক্ত সার ব্যবহার না করার ব্যাপারে কৃষকদের কোনো বার্তা দেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা কৃষকদের সচেতন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, যাতে তারা তাদের অনুমোদিত মাত্রার অতিরিক্ত সার প্রয়োগ না করেন।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত কৃষকদের সঙ্গে গ্রুপ মিটিং ও ইয়ার্ড মিটিং করছি। জমিতে যাতে কেউ অনুমোদিত মাত্রার বেশি সার প্রয়োগ না করেন তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা প্রচারণাও চালাচ্ছি।”
ঢাকা/ইমন