গাইবান্ধার পরিস্থিতি
দিশেহারার আশা ‘ঝুঁকির রিকশা’
মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম
বেকারি ব্যবসায় লাভ করতে না পেরে এখন ব্যাটারির অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন গাইবান্ধা শহরের মাস্টার পাড়ার তরুণ শুভ মিয়া। ছবি: রাইজিংবিডি।
“এই পেশায় কোনো ঝুঁকি বা ঝামেলা নেই। পরিশ্রম করলে লোকসানের শঙ্কা নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। কিনে ব্যাটারি চার্জ দিয়েই পরের দিন অটোরিকশা থেকে আয় শুরু করা যায়। সাত-পাঁচ না ভেবেই তাই এই পেশা বেছে নিয়েছি।”
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধা শহরের মাস্টারপাড়ার তরুণ শুভ মিয়া। শুধু শুভ মিয়া নন, ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা এই ব্যাটারির অটোরিকশায় পেশা খুঁজে নিচ্ছেন গাইবান্ধার অনেক মানুষ। এমন কী মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষও অটোরিকশা নিয়ে নেমে পড়ছেন রাস্তায়। চড়া মূল্যের বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে তিন চাকার এই যানে ঘোরানোর চেষ্টা করছেন সংসারের চাকা।
তরুণ শুভ মিয়া বলেন, “আজ থেকে ছয় মাস আগে বেকারির ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তবে, লাভের মুখ দেখেনি। আরো কিছু ব্যবসা করেছি। সেখানেও একই অবস্থা। তাই ধার-দেনা করে একটি ব্যাটারির অটোরিকশা কিনেছি। কারো ওপর নির্ভর করতে হয় না। নিজেই চালাই। যা আয় হয় তা দিয়েই চলছে সংসার।”
গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের দশানি গ্রামের অটোরিকশা চালক রাকিব মিয়া, বয়স ২০ বছর। তিনি বলেন, “আগে চাকরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। ব্যবসা খারাপ হওয়ার কথা বলে তারা নেয়নি। আমার বাবা অটোরিকশা চালাতেন। এখন তার বয়স হয়েছে। তাই আমাকেই গাড়ি নিয়ে সড়কে যেতে হয়।”
“পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পরিবারের হাল ধরতে অটোরিকশা চালাচ্ছি। অটোরিকশায় যাত্রী বহন করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলছে।”
পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পরিবারের হাল ধরতে অটোরিকশা চালাচ্ছেন সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের দশানি গ্রামের রাকিব মিয়া। ছবি: রাইজিংবিডি।
শহরের ব্রিজরোড এলাকার বাসিন্দা রাশেদ হাসান একজন শিক্ষিত যুবক। রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, একদিন তাদের ভালো দিন ছিল। তার বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন রাশেদ। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর বাড়ির সঙ্গে একটি ঘরে নিজেই শুরু করেন ফার্মেসির ব্যবসা। বেচা-বিক্রি কম হওয়ায় সেই ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায় তার। পরে বাধ্য হয়ে ব্যাটারির অটোরিকশা কিনেছেন তিনি।
রাশেদ বলেন, “সৎ উপায়ে আয় করায় লজ্জার কিছু নেই। ব্যাটারির অটোরিকশার চার্জ ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা টেকান যায়। তা দিয়েই কোনোমতে চলে যায় সংসার।”
“আর এখন কোনো ব্যবসার অবস্থাই ভালো না। শহরে এখন অনেক অটোরিকশা ও মিশুক বেড়েছে। ঢাকায় যারা বিভিন্ন কাজ করতেন, তারাও এখন গাইবান্ধায় এসে অটোরিকশা বা মিশুক চালাচ্ছেন,” যোগ করেন রাশেদ।
গাইবান্ধা পৌরসভা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুধু পৌরসভায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাটারির অটোরিকশা, মিশুক ও পায়ে চালিত রিকশার সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার। এবছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার।
এর বাইরেও প্রায় কয়েকশ অটোরিকশা আছে, যেগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের জানা নেই।
গাইবান্ধা শহরের রাস্তা এখন ইজিবাইকের দখলে। ছবি: রাইজিংবিডি।
ব্যাটারির অটোরিকশা, মিশুক, রিকশা ও ভ্যানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শত শত পার্টসের দোকান। নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপ, টায়ার, ব্যাটারির দোকান। অটোরিকশা সংশ্লিষ্ট এসব দোকানেও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ফারাজি পাড়ার অটোরিকশার ওয়ার্কসপ ব্যবসায়ী শাহাদত হোসেন। রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “এসব গাড়ির কন্ট্রোল বক্স পুড়ে যায়, স্টিয়ারিং ছিঁড়ে যায়, বিয়ারিং ভেঙে যায়, ব্রেক ‘লুজ’ হয়ে যায়, নষ্ট পার্টস বদলে দিতে হয়, ইঞ্জিনের তেল বদলাতে হয়।”
“মোটরের মিস্ত্রি, পেইন্টিং মিস্ত্রি, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, ইঞ্জিনের মিস্ত্রি, সহকারী সব মিলিয়ে একেকটা দোকানেই পাঁচ থেকে সাতজনের কর্মসংস্থান হয়।”
গাইবান্ধা অটোরিকশা চালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চান ভাণ্ডারি বলেন, “বর্তমানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বহু মানুষ বেকার। তারা এনজিও থেকে লোন করে অটোরিকশা কিনছেন। অটোরিকশা আর মিশুকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন কারো আয়ও তেমন ভালো নয়। তবুও তাদের কোনো রকমে সংসার চলছে। অটোরিকশার কারণেই বেকাররা চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় জড়াচ্ছেন না। বেকাররা হতাশ হয়ে পড়ছেন না।”
গাইবান্ধা নাগরিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম গোলাপ বলেন, “স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গাইবান্ধায় বারবার রাজনীতির পালা বদল হয়েছে। কেউ নিজের স্বার্থ ছাড়া জেলার উন্নয়নের কথা ভাবেননি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতেও এই জেলায় একটি শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি।
যাত্রীর অপেক্ষায় দুই অটোরিকশা চালক। ছবি: রাইজিংবিডি।
“অথচ, জাতীয় জাতীয় সংসদে গাইবান্ধার সংসদ সদস্যরা ডেপুটি স্পিকার ও হুইপের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা চাইলেই গাইবান্ধায় শিল্প কলকারখানা এবং মিনি গার্মেন্টস নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারতেন। এতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। অনেকেই এখন বাঁচার তাগিদে অটোরিকশার চালক হয়েছেন। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।”
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও গাইবান্ধা পৌর প্রশাসক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমরা গত বছর পর্যন্ত শহরে চলাচলের জন্য প্রায় ছয় হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও মিশুকের অনুমতি দিয়েছিলাম। এ বছর এখনো নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স দেওয়ার কাজ চলছে। তাই সঠিক পরিসংখ্যান বলা যাচ্ছে না।”
“যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা অটোরিকশাকে হলুদ এবং সবুজ রঙের নম্বর প্লেট দিচ্ছি। হলুদ প্লেটধারী অটোরিকশা শনিবার চললে রবিবার সেগুলো বন্ধ থাকবে। সেদিন সবুজ রঙের নম্বর প্লেটধারী গাড়ি চলাচল করবে। আশা করি, এতে শহরে যানজট অনেকটাই কমে যাবে,” যোগ করেন তিনি।
ব্যাটারির অটোরিকশা নিষিদ্ধের দাবি রয়েছে সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর। যাত্রী কল্যাণ সমিতিও এই দাবি করে আসছে। আদালতেও উঠেছে বিষয়টি।
গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে রুল জারি করেন আদালত।
গাইবান্ধা পৌরসভার তথ্য, গতবছর এই শহরে অটোরিকশা, মিশুক ও পায়ে চালিত রিকশার সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। ছবি: রাইজিংবিডি।
প্যাডেল চালিত রিকশা সমিতির করা একটি রিটের প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
২৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এসে রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং এর যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করার দাবি জানায়।
এর পরদিন থেকেই ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটো চলাচল অব্যাহত রাখার দাবিতে বিক্ষোভ করেন রিকশাচালকরা।
পরে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে গত ২৫ নভেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। পরে হাইকোর্টের আদেশে এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দেন চেম্বার আদালত।
এর আগে, চলতি বছরের মে মাসে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশা চলবে না। এগুলো চলতে যেন না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”
তার এমন ঘোষণার পরেই অটোরিকশা বন্ধে অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। তবে সেটিও ধোপে টেকেনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে।
ঢাকা/মাসুদ/রাসেল