বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
আহত হারুন-সুজনরা কাঁদছেন, পাননি সরকারি সহায়তা
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে জেলার সিভিল সার্জনের সরকারি তালিকা অনুযায়ী আহতদের সংখ্যা ২৩৯ জন। এদের মধ্যে কেউ গুলিবিদ্ধ, কেউ রাবার বুলেটে আহত; কারো ভেঙে গেছে হাত-পা। আবার অনেকের চোখে আঘাত লেগেছে।
আহতদের অনেকে চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠলেও এখনো সুস্থ হননি হারুন (২৮), সজিবুল ইসলাম (২২) ও খালেদ মাহমুদ সুজন (১৮) সহ ১৪ জন। আহতদের স্বজনদের অভিযোগ, এখন পর্যন্ত তারা পাননি সরকারি কোনো সহায়তা।
হারুন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার টুমচর গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে। তিনি লক্ষ্মীপুর শহরের একটি দর্জির দোকানে কাজ করতেন। তার বাবা মৃত রেজাউল করিম পেশায় দিনমজুর ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন হারুন।
বিধবা মা, দাদি ছাড়াও সংসারে ছোট তিন বোন রয়েছে। গত ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর ঝুমুর এলাকা থেকে বের হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেন হারুন। তমিজ মার্কেট এলাকায় পৌঁছালে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার গুলিবিদ্ধ ডান পায়ে এখন পচন ধরেছে।
হারুন বলেন, ‘‘বাবার মৃত্যুর পর সংসারে হাল ধরতে লেখাপড়া ছেড়েছি। আর এখন নিজেই পরের অনুগ্রহের দ্বারস্থ হয়েছি। আহত হয়েও চিকিৎসার খরচ নিজেরই জোগাড় করতে হচ্ছে। জেলা জামায়াত ইসলামীর নেতৃবৃন্দ কিছুটা খরচ বহন করেছেন। তবে, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো সহায়তা বা কেউ খোঁজ নেয়নি।’’
সজিবুল ইসলাম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের মো. হাসানের ছেলে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি জেলা শহরের একটি দোকানে চাকরি করতেন। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তার চিকিৎসায় সর্বস্ব হারায় পরিবার।
সজিবুলের বাবা অটোরিকশাচালক হাসান বলেন, ‘‘সজিবুলের চিকিৎসা করাতে টাকা-পয়সা সব শেষ। আর্থিক সংকটে এখন ঔষধ কিনতে পারছি না। তবে, এখনো সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি।’’
লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে আরেক গুলিবিদ্ধ কলেজছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন। তার ঘাড়-গলা, ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে এখনো ৮টি বুলেট রয়ে গেছে। সুজন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা এলাকার শাহীন কাদিরের ছেলে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, অর্থাভাবে সুজনের চিকিৎসা করাতে পারছেন না তারা। চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, কেবল বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমেই শরীর থেকে গুলি বের করা সম্ভব। সুজন পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের খরচ যোগাতে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। অসুস্থ হওয়ায় এখন সেটাও বন্ধ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ে তথ্যমতে, লক্ষ্মীপুরে হারুন-সজিবুল-সুজনের মতো গুরুতর আহত রয়েছেন আরো ১৪ জন। তারা হলেন- জসীম, ইয়াসিন আরাফাত, তাজুল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, ইউসুফ আল-মাহমুদ, রায়হান, মাহবুব আলম, ইব্রাহিম, খলিল রায়হান, জোনায়েদ হোসেন, আসিক মাহমুদ ও আব্দুল আহাদ। গত ২৩ নভেম্বর
গুরুতর আহতদের চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতা মো. আরমান হোসেন বলেন, ‘‘লক্ষ্মীপুরে ছাত্র-আন্দোলনে আহতদের জন্য এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা আসেনি। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ১৪ জন গুরুতর আহতসহ ২৬০ জনের নাম পেয়েছি। তবে, এখনো প্রায় শতাধিক আহতের নাম তালিকায় যোগ করা বাকি রয়েছে।’’
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার হাওলাদার বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২৫৯ জনের একটি নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। তবে, আহতদের মধ্যে আরো অনেকে ছিল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি বলে নাম পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্য, প্রথম পর্যায়ে ১০৪ জনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।’’
জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বলেন, ‘‘আন্দোলনে আহত এবং নিহতদের তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানোর কাজ চলমান রয়েছে। তাদের আর্থিক সহায়তা কেন্দ্রীয়ভাবে করা হবে। ইতিমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেককে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। এটি চলমান রয়েছে। গুরুতর আহতদের সু-চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তাদের নাম সুপারিশ করে আর্থিক সহযোগিতার জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে।’’
ঢাকা/লিটন/রাজীব