হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ উদ্বোধনের ফটোসেশন, তারপর হাওয়া
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
ফটোসেশনের পর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উদ্বোধনের সরঞ্জাম
সুনামগঞ্জ জেলার হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে বিগত সরকার আমলের মতো এবারও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলেছেন কৃষক। বাঁধের উপরে মাটি ফেলে নামমাত্র বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
হাওর-অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবল বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রায় প্রতিবছরই দেখা দেয় অকাল বন্যা। মার্চের দিকে শুরু হওয়া এই বন্যায় হাওরের বোরো ধান ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ধান রক্ষায় প্রতিবছর সুনামগঞ্জ জেলার হাওরগুলোতে নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ।
একই ধারাবাহিকতায় এ বছর ফসলের সুরক্ষায় সুনামগঞ্জ জেলার ৫৩টি হাওরে ৫৮৮ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করবে সরকার। এতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থ বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যে হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ করার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে নির্ধারিত ১৫ ডিসেম্বর জেলাব্যাপী বাঁধ নির্মাণ কাজের নাটকীয় উদ্বোধনের অভিযোগ উঠেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ফলে এবারও হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির শঙ্কায় রয়েছেন হাওরের কৃষক।
রোববার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাংলার হাওরের ১ নং প্রকল্পে বাঁধের উপরে মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদদ রেজাউল করিম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অতীশ দর্শী চাকমা, রঙ্গারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাইসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে থাকা অন্যান্য লোকজন।
দেখা যায়, এ প্রকল্পে বাঁধের গোড়া থেকে কয়েক টুকরি মাটি এনে বাঁধের উপরে রাখেন কয়েকজন শ্রমিক। অতিথিরা বাঁধে রাখা মাটিতে কোদাল রেখে ফটোসেশন করেন। কর্মকর্তারা বাঁধের উপর থেকে চলে আসার সাথে সাথে পিআইসির লোকজন বাঁধের কোনও কাজ না করে প্রকল্পের সাইনবোর্ডসহ সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি চলে যান।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ উপজেলায় নামমাত্র বাঁধের কাজ উদ্বোধন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। লোক দেখানো এমন কাজের উদ্বোধনে উদ্বেগ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষক ও সচেতন নাগরিক।
শাল্লা উপজেলার বাসিন্দা তারেক মিয়া বলেন, “আজ নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে তড়িঘড়ি করে হাওরের বাঁধের কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে যেটা কোনো কাজেরই না। কেবল মানুষ দেখানোর জন্য বাঁধে কয়েক টুকরি মাটি ফেলা হয়েছে।”
নাম না প্রকাশের শর্তে কাংলার হাওরের একজন কৃষক বলেন, “প্রতিবছর আমরা গরীবের ধান রক্ষায় সরকার টাকা দেয় কিন্তু কর্মকর্তারা সেই কাজে অবহেলা করেন। দিন শেষে সব ক্ষতি আমাদের হয়। এবার সরকারের কাছে দাবি জানাই অন্তত বাঁধের কাজটা যেনো সঠিকভাবে সঠিক সময়ে শেষ করে।”
উদ্বোধনের পর পর কাজ না করে বাঁধ থেকে সরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ১নং পিআইসির সভাপতি হাবিব উল্লাহ বলেন, “আমাদের আগে থেকে জানানো হয়নি। জানালে আগেই মেশিন রেডি করে রাখতাম। এসও স্যার কাজ উদ্বোধনের কথা বলায় কয়েকজন শ্রমিক এনে বাঁধে মাটি ফেলা হয়েছে। তবে মাটি কাটার মেশিন রাস্তায় রয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে কাজ শুরু করা যাবে।”
বাঁধের কাজে লোক দেখানো উদ্বোধনে উদ্বেগ জানিয়েছেন হাওর ও কৃষকের সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’। সংগঠনটির সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন বলেন, “বাঁধ উদ্বোধনের নামে মানুষের সাথে তামাশা হয়েছে। বাঁধে কয়েক টুকরি মাটি ফেলে নিয়ম রক্ষা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন লোক দেখানো উদ্বোধনের মাধ্যমে পাউবো ও জেলা প্রশাসন কৃষকদের নেতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই এবারও যদি নির্ধারিত সময়ের আগে বাঁধের কাজ শেষ না করা হয় আর এতে কৃষকের ফসল ঝুঁকিতে থাকে তাহলে জেলার সকল কৃষকদের সাথে নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।”
সুনামগমঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, “হাওর থেকে পানি না নামায় কাজ শুরু করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর জেলার প্রতি উপজেলায় বাঁধের কাজ উদ্বোধন হয়েছে।”
উদ্বোধনের পর কাজ না করে বাঁধ থেকে প্রকল্পের সাইনবোর্ডসহ সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে আসার কারণ টা কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এখনও পানি নেমে যায়নি, পানি নামলে পুরোদমে কাজ শুরু হবে। তখন বাঁধে সাইনবোর্ড থাকবে, সার্বক্ষনিক শ্রমিকও থাকবে। পানিটা কমলে আমরা কাজ করতে পারবো।”
ঢাকা/মনোয়ার/টিপু