বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত
সজীব-সাজিদের খোঁজ নেয়নি কেউ
তামিম ইসলাম, ফরিদপুর || রাইজিংবিডি.কম
সজীব ইসলাম সানি ও সাজিদ মন্ডল।
ফরিদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জেলার সিভিল সার্জনের সরকারি তালিকা অনুযায়ী আহতদের সংখ্যা ৯০ জন। এদের মধ্যে কেউ গুলিবিদ্ধ, কেউ রাবার বুলেটে আহত, কেউ সাউন্ডগ্রেনেড আঘাতপ্রাপ্ত, আবার কারো কারো হাত-পা ভেঙে গেছে। এছাড়াও অনেকের চোখেও লেগেছে আঘাত। এদের মধ্যে কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠলেও এখনো সুস্থ হয়ে উঠেনি সজীব ইসলাম সানি (২৩) ও সাজিদ মন্ডল (২০)। এদের একজন বর্তমানে ঢাকার সিআরপিতে, আরেকজন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। সজীব ও সাজিদের অভিযোগ, এখনো তারা সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সাহায্য পাননি। এমনকি তাদের খোঁজ-খবরও রাখেনি কেউ।
সজীব ইসলাম সানি ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে রসায়ন বিভাগে অনার্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তার বাবা মৃত আব্দুল মালেক ছিলেন পেশায় রাজমিস্ত্রি। বিধবা মা আর ছোট একটি বোনকে নিয়ে থাকেন শহরের বায়তুল আমান এলাকায়। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোনটি ফরিদপুর কমার্শিয়াল কলেজের ছাত্রী।
৪ আগস্ট সকালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে বের হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সানি। থানা রোডে এসে সাউন্ড গ্রেনেড আর কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন। আত্মরক্ষার জন্য হিতৈষী স্কুলের দিকে গেলে সেখানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলার শিকার হন। বেধড়ক পিটিয়ে সারা শরীরে থেঁতলানো আঘাত ছাড়াও ডান হাত ভেঙে গেছে। ফরিদপুর মেডিকেল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় সিএমএইচে পাঠানো হয়। হাতে অপারেশন করে রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও হাতের কব্জি এখন আর কাজ করে না। হাড় ভাঙার পাশাপাশি তার নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গেছে। গত ১৬ নভেম্বর সাভারের সিআরপিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।
সজীব ইসলাম সানি জানান, টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি সংসারও চালাতাম। এখন আমি নিজেই পরের অনুগ্রহের দ্বারস্থ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই সদস্যের অসুস্থতা গোটা পরিবারকে ভোগাচ্ছে।
সজীব আরো জানায়, আহত হয়ে হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ তার নিজেরই জোগাতে হয়েছে। পরে হাতের অপারেশনের সময় তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনামূল্যে করে দেয় হাসপাতাল থেকে। যার জন্য সর্বোচ্চ হাজার দেড়েক টাকা খরচ হতো। তবে রড, স্ক্রু ও অন্যান্য ওষুধের খরচ তাকেই দিতে হয়েছে।
জানা যায়, ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তালিকায় ৩২ নম্বরে তার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফরিদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আহত শিক্ষার্থী এই সজীব ইসলাম সানি। তার আর্থিক অবস্থা ভালো না। তবে সজীব এখনো সরকার থেকে কোনোরকম সাহায্য সহযোগিতা পায়নি।
এছাড়াও শহরের উপকণ্ঠে বিসমিল্লাহ শাহ্ দরগার পাশে কৈজুরি গ্রামের হতদরিদ্র আরেক দিনমজুর বাবা জাহাঙ্গীর মন্ডলের ছেলে সাজিদ মন্ডল (২০)। ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ১ম বর্ষ (পাওয়ার) ছাত্র। দুই বোন এক ভাই তারা। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পূর্ব খাবাসপুরের দৌড়ে যাওয়ার সময় হিতৈষী স্কুলের পেছনে তাকে ও লামীম নামে আরেকটি ছেলেকে মুখ বেধে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় সাজিদ। তার ডান হাতের আঙুল, বাম হাতের মাঝ বরাবর ও ডান পায়ের গোড়ালির থেকে টাকনুর মাঝামাঝি ভেঙে গেছে। হাসপাতাল থেকে রড ঢুকিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর এখন বাসায় রয়েছে। ৩-৪ মাস পর হাসপাতাল থেকে রডের স্ক্রু খুলতে যেতে হবে। এক বছর পর বড় একটি অপারেশন করাতে হবে বলেও জানিয়েছে চিকিৎসকেরা।
বর্তমানে বাসায় থেকেই চিকিৎসা চলছে সাজিদের। তার দশা খুবই করুণ হয়ে উঠেছে। চিকিৎসা ব্যয়ই মিটছে না তার। পুষ্টিহীনতার শিকার সাজিদের হাড়গোড় বেরিয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলেও আর কেউ খোঁজ রাখেনি তার। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা পায়নি।
এদিকে হিতৈষী স্কুলের পেছনে ৪ আগস্ট সাজিদের সাথে আরো কয়েকজনকে পিটিয়েছিলো যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থকেরা। তাদের মধ্যে ছিলো মৃত সাংবাদিক কেএম রুবেলের ছেলে লামীম ইসলাম (১৭)। তার বাড়িও বায়তুল আমানে। ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১ম বর্ষের ছাত্র লামীম তার খালাতো বোনের সাথে ৪ আগস্টের মিছিলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে যোগ দিয়েছিলেন।
লামীম জানায়, ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে শহরের পশ্চিম খাবাসপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনি ও তার খালাত বোন নুরজাহান যোগ দেয়। এরপর ভাঙা রাস্তার মোড় হয়ে আলীপুরে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে ফরিদপুর প্রেস ক্লাব এলাকা হয়ে ঝিলটুলী দিয়ে সারদা সুন্দরী কলেজের সামনে থেকে তারা থানা রোডে বারী প্লাজা মার্কেটের সামনে পৌঁছলে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকা পরে। এ সময় পুলিশ টিয়ারসেল ছুড়লে তাতে আহত হয় সে। এ সময় তারা আত্মরক্ষার জন্য হিতৈষী স্কুলের গলি দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়। তাদের মুখ বেধে বেধড়ক পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়।
ফরিদপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবরার নাদিম ইতু বলেন, “ফরিদপুরে আন্দোলনে আহতদের জন্য আমরা কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে ৯ জনের মতো শিক্ষার্থীকে কিছু সাহায্য করেছি। এছাড়া ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অয়ন নামে এক ছাত্রের জন্য কিছু টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছি। কিন্তু তাদের জন্য আমরা সেভাবে কিছুই করতে পারিনি।”
সরকারের উচিত তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা বলেও জানান তিনি।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এসএম আলী আহসান বলেন, “ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের তালিকা তৈরি করছে।”
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ফরিদপুর থেকে ৬০ জনের মতো একটি তালিকা প্রেরণ করা হয়েছে। এখনো ঢাকা থেকে কিছু জানানো হয়নি। তবে আহতদের মধ্যে আরো অনেকে ছিলো। তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি বলে তাদের নাম পাঠানো সম্ভব হয়নি বলেও জানানো হয়।
ঢাকা/ইমন