র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে ভারতে, ১৬ মাস পর বাড়ি ফিরল নিখোঁজ যুবক
সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
মায়ের সান্নিধ্যে রহমতুল্লাহ
ঢাকার ধামরাই থেকে ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট র্যাব পরিচয়ে রাতের আধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রহমতুল্লাহ নামে এক যুবককে। এর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরও তার কোনো সন্ধান মিলছিল না। অবশেষে সেই রহমতুল্লাহর খোঁজ মেলে গতকাল শনিবার।
রবিবার (২২ ডিসেম্বর) পুলিশের সহায়তায় ১৬ মাস পর বাড়ি ফেরেন সেই রহমতুল্লাহ। তাকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত পরিবার ও এলাকাবাসী।
রহমতুল্লাহ বলছেন, এতদিন তিনি ভারতে বন্দী ছিলেন। শনিবার (২১ ডিসেম্বর) তাকে চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
রহমত উল্লাহ ধামরাই উপজেলার গাংগুটিয়া ইউনিয়নের বড়নালাই গ্রামের মৃত আবদুর রবের ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রহমতুল্লাহ সবার ছোট। বড় ভাই সৌদিপ্রবাসী। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মা ও ভাবির সঙ্গে বাড়িতেই থাকতেন তিনি এবং ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ শিখছিলেন।
কেন, কী কারণে র্যাবের পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়– সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছেন না রহমতুল্লাহ ও তার স্বজনরা।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পান রহমতুল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ। অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ফজলে বারী পরিচয় দিয়ে রহমতুল্লাহকে পাওয়ার কথা জানান। ওবায়দুল্লাহ খোঁজ নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর পরিবারের ৪ সদস্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যান।
মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, “এস আই মো. ফজলে বারীর কল পেয়ে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে রহমত উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসি। শুরুতে রহমতুল্লাহ আমাকে চিনতে পারছিল না। এখনো খুব বেশি কথা বলতেছে না।”
বাড়িতে ফিরেও অনেকটাই চুপচাপ রহমতুল্লাহ। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। প্রশ্ন করা হলে চুপ থাকছেন। কিছু প্রশ্নের অল্প কথায় জবাব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “ভারতের জেল থিকা বাইর করছে, তারপর বাংলাদেশে নিয়া আসছে। আজকে বাড়ি আসছি।”
ফিরে আসা রহমতুল্লাহ (মাঝে)
১৬ মাস কোথায় ছিল রহমতুল্লাহ!
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার পুলিশ জানায়, থানায় আসার পর রহমতুল্লাহ তাদের জানিয়েছেন, গত বছরের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে র্যাব তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর ঢাকায় ৯ মাস চোখ, হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়। যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল, এর আশপাশে বিমান ওঠানামা করত। শুধু খাওয়ার সময় চোখ খোলা রাখা হতো। খাওয়া শেষ হলে আবার তার চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এভাবে ৯ মাসের মতো রাখার পর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাইয়েস গাড়িতে করে তাকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়। সীমান্ত পার করে রহমত উল্লাহকে ভারতের সীমানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দু-তিন দিন ভারতে ঘোরার পর ভারতের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
রহমত উল্লাহ পুলিশকে জানিয়েছেন, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে তাকে একটি জেলে রাখা হয়। সেখানে ৬ মাসের সাজা হয়। এ ছাড়া ১ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ মাস জেল খাটতে হবে-এমন সাজা হয়। ৭ মাস জেল খাটার পর সর্বশেষ দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে আনা হয়। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়। পরে তিনি গোমস্তাপুর থানায় যান। এরপর থানা-পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরিবারের তথ্য নেয়।
রহমত উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদকারী রহনপুর তদন্তকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ মো. ফজলে বারী বলেন, “প্রথমে রহমতুল্লাহ সন্দেহ করছিলেন, পুলিশ তাকে মেরে ফেলতে পারে। তবে পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলে তার কাছ থেকে পরিবারের তথ্য নিয়ে ধামরাই থানা-পুলিশের সহযোগিতায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে তার পরিবারের সদস্যরা থানায় পৌঁছালে নিশ্চিত হতে শনাক্তকরণ মহড়া হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ৫ জন লোককে তার সামনে রেখে ভাইকে শনাক্ত করতে বলা হলে তিনি ভাইকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।”
মো. ফজলে বারী বলেন, “তাকে (রহমতুল্লাহকে) জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাকে ধরল কেন? সে উত্তরে বলেছিল, ‘তারা বলছে (র্যাব) আমি নাকি জঙ্গি করি।’ তখন সিডিএমএস (সফটওয়্যার ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সার্চ করে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পাইনি।”
গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল বাসার বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, ৯ মাস তাকে দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে রেখেছিল। এরপর যশোর সীমান্ত এলাকায় মোটরসাইকেলওয়ালা দুজন লোকের কাছে দেওয়া হয়। পরে ওরা ভারতে নিয়ে যায়। পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে যাওয়ায় ভারতের পুলিশ মামলা দিলে ৭ মাস জেল খেটেছেন। গত পরশু গভীর রাতে নৌকা করে রহমত উল্লাহকে নদী পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরে তিনি লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এটা কোন এলাকা? লোকজন তাকে এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর জানান। এরপর তিনি থানার আসেন।”
প্রায় ১৬ মাস পর রবিবার দুপুরের দিকে বাড়িতে পৌঁছান রহমত উল্লাহ (২১)। ছেলেকে জীবিত ফিরে পাবেন কি না সেটি জানা ছিল না মা মমতাজ বেগমের। ছেলেকে পেয়ে তিনি বলেন, “ছেলেরে আমি পাইছি, আমি শান্তি পাইছি। আল্লায় আমার ছেলেরে আমার বুকে আনছে।”
মমতাজ বেগম বলেন, “আমার ছেলের ৮ দিন জ্বর আছাল (ছিল)। আমার কাছেই শুয়া আছাল, র্যাব আর সাদাপোশাকে মানুষ ঘরে আইসা ধইরা নিয়া গেছিল। তারা কইছিল জিজ্ঞাসাবাদ কইরা ছাইড়া দিমু। র্যাব অফিসে, ডিবি অফিসে, পুলিশের কাছে গেছি কতবার, কোনো খোঁজ পাই নাই। আমার বাবারে এখন ফিরা পাইছি।”
রহমতুল্লাহর বোন জাকিয়া সুলতানা বলেন, “অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ভাইকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আল্লাহর কাছে শুধু আমার ভাই রহমতুল্লাহকে ফেরত চেয়েছি। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করেছেন।”
ধামরাই থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, “ধামরাই থানায় তার পরিবারের করা সাধারণ ডায়রির পরিপ্রেক্ষিতে রহমতুল্লাহকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজা হয়েছে। কিন্তু তার সন্ধান পাইনি। শনিবার বিষয়টি গোমস্তাপুর থানার ওসির মাধ্যমে জানতে পারি, রহমত উল্লাহ তাদের তদন্ত কেন্দ্রে আছে। সেখান থেকে রবিবার দুপুরে তার ভাই ও ভগ্নিপতি তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন। নিখোঁজ থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”
ঢাকা/সাব্বির/টিপু