৭ খুন: যেভাবে দেখছেন মনোবিজ্ঞানী
চাঁদপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ইরফান ওরফে আকাশ মন্ডল (মাঝে)
এর আগে কোনো ধরনের বড়সড় অপরাধমূলক কাজে না জড়িয়েও ঠান্ডা মাথায় চাঁদপুরের জাহাজে সাত জনকে খুনের ঘটনায় ইরফানের (২৬) বয়সকে টার্গেট করে বিভিন্ন এঙ্গেল খুঁজে বের করেছেন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডা. এ এম ফরিদুজ্জামান।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় ইরফানের এই নৃশংস কাজের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই মনোবিজ্ঞানী।
একজন সুস্থ্য স্বাভাবিক লোক কীভাবে এতোগুলো মানুষকে খুন করতে পারে? এ বিষয়ে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডা. এ এম ফরিদুজ্জামান বলেন, “ইরফানের মোটিভ কী ছিল এবং সে সাইকোপ্যাথ কিনা সেটি জানা এক্ষেত্রে জরুরি। তবে ২৬/২৭ বয়সের যুবকদের এই ধরনের খুন করার বেশ ঝোঁক থাকে। মূলত এই বয়সী যুবকদের যারা ‘এন্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজ অর্ডারের মানুষ’ তারা দেশের বা সমাজের আইন কানুন মানতে চায় না। অর্থাৎ কোন নিয়মে আবদ্ধ থাকতে চায় না।”
তিনি বলেন, “রাগ উঠলে ইরফানরা মারপিট, ভাঙচুর যেকোনো কিছু করতে পারে। পার্সোনালিটি যদি সিডিয়ার হয় সেক্ষেত্রে এই বয়সী যুবকরা একজন সন্ত্রাসীতে পরিণত হতে পারে কিংবা সে একজন সাইকোপ্যাথ হতে পারে। এই বয়সটাতে এদের অপরাধবোধ কাজ করে না। এরা যে কাজ করে সেটা কেনো করে সেটাও তারা জানে না বা বুঝতে চায় না। এরা খুব ছোটখাটো বিষয়েও ভাঙচুর মারধর পর্যন্ত করতে পারে। তার মারধরের শিকার লোকটি মারা গেলো কিনা সেটিও তারা বুঝতে চায় না বা তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে না।”
তিনি আরো বলেন, “ইরফানের বয়সের ছেলেরা অনেক সময় তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ইউরিন টেস্ট করলেই সে নেশা করতো কিনা বেরিয়ে আসবে। ওই পার্সোনালিটি যুবকদের ক্রিমিনাল এক্টিভিটি থাকে। সিবিআর হলে মার্ডার করাটা স্বাভাবিক। সে মূলত রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাতে পারে এবং এটা সুস্থ মস্তিষ্কে ঠান্ডা মাথাতেই করা সম্ভব।”
এদিকে চাঁদপুর জেলা জজ কোর্টের এপিপি অ্যাডভোকেট ইয়াসিন আরাফাত জানান, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান বিচারককে বলেন, “মানুষ ভুল করে। আমিও ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
খবর নিয়ে জানা যায় সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ইরফানের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশের কাছেও কাগজে কলমে কোনো অভিযোগ নেই। এ বিষয়ে বাগেরহাটের ফকিরহাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর কবির বলেন, “ইরফান ওরফে আকাশ মন্ডলের নামে আমাদের থানায় কোনো প্রকারের লিখিত অভিযোগ নেই। এলাকায় খবর নিয়েছি সে খুব শান্ত শিষ্ট স্বভাবের ছিল।”
এই সাত খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হরিণা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. কালাম খান বলেন, “ইরফান আমাদের কাছেই রয়েছে। সাত দিনের রিমান্ডের প্রথম দিনে তার থেকে অনেক তথ্যই পেয়েছি। বাকি দিনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য বের করব। আহত জুয়েলের সাথেও আমার যোগাযোগ রয়েছে।”
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌযান পরিবহনের চাঁদপুর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শ. আ. মাহফুজ উল আলম মোল্লা বলেন, “অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত জাহাজটিতে পাইলট ছিল না। এমনকি তাতে স্কট, সিসি ক্যামেরা, ভিএইচএফ যন্ত্রপাতিও ছিল না। সেক্ষেত্রে জাহাজটি কীভাবে এতোদিন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নদীতে চলাচল করেছে? সে নিয়েও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি। কেননা অবৈধ রেজিস্ট্রেশন বিহীন কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে প্রায়ই আমরা জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।”
তিনি বলেন, “ঘটনার খবর শুনেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম জাহাজটি নোঙ্গর করা ছিলো না বরং চরে আটকে ছিলো। ওটাতে পাইলটও ছিলো না। যে কারণে নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে দেখতে পাই জাহাজটি। ইরফান খালাসী পদে কাজ করতো। মূলত খালাসীরা সাধারণত লস্করের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তারা জাহাজের ডেকে মালামাল স্থানান্তর করতো এবং ডেকে বা যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে থাকে। কোনোভাবেই মাস্টারের ভূমিকায় জাহাজ চালানোর কথা না। তবে দেখে দেখে হয়তো জাহাজ কিছু সময় চালাতে পারে তবে দক্ষ চালক বা মাস্টারের মতো কখনোই চালাতে পারে না। এজন্যই হয়তো ইরফান যে সময়টুকু জাহাজটি চালিয়েছে সে সময়েই জাহাজটি নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে চলে যায় এবং চরে আটকা পড়ে এবং নোঙ্গর করা ছিলো না।”
এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, “৭২০ মেট্রিকটন ইউরিয়া সার ছিলো কার্গো জাহাজটিতে। তা অক্ষত হওয়ায় এবং এগুলো সরকারি সার হওয়ায় দ্রুত তা ওই জাহজ হতে আনলোড করে স্থানান্তরিত করতে অন্য একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ওই জাহাজ থেকে মাল আনলোডের কাজ শুরু হবে। তদন্ত টিমও তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এর আগে আমরা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের প্রত্যেককে ২০ হাজার এবং নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকার চেক দিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “এখন পর্যন্ত চাঁদপুরের এই সাত খুনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং রহস্য উন্মোচনে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্য, জেলা প্রশাসন ৪ সদস্যের এবং জেলা পুলিশ ৩ সদস্যের পৃথক তদন্ত টিম গঠন করেছে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।”
উল্লেখ্য, গত ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা হতে ২৩ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার যেকোন সময়ে চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালাস্থ মনিপুর টেক খাল পাড় সংলগ্নে জাহাজে ৭ জন খুনের ঘটনাটি ঘটেছে বলে মামলা হয়। এম.ডি. আল বাখেরা কার্গো জাহাজটি ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮ টায় চট্টগ্রাম কাফকো জেটি থেকে ইউরিয়া সার বোঝাই করে ৯ জন কর্মচারীদেরকে নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে।
২৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় খুনের ওই ঘটনা সামনে আসে। এতে এম.ডি. আল বাখেরা জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী খুন হন। এ ছাড়া গুরুতর আহত ব্যক্তি হন জাহাজটির সুকানি জুয়েল।
ঢাকা/অমরেশ/সনি