ঢাকা     বুধবার   ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ১৮ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে গরু দিয়ে হালচাষ

যশোর সংবাদদাতা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৫:২২, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
বিলুপ্তির পথে গরু দিয়ে হালচাষ

গরু দিয়ে হালচাষ শেষে বাড়ি ফিরছেন ‍দুই কৃষক। ছবিটি মনিরামপুর কাটাখালি বীল থেকে তোলা।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাপ-দাদার সেই পুরনো স্মৃতি লাঙল-গরুর হালচাষ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। চাষি খেতে চালাচ্ছে হাল, তাঁতি বুনছে তাঁত, জেলে ধরছে মাছ জালে। গ্রামবাংলার কর্মময় এ সত্য সৌন্দর্য এখন যেন অনেকটাই স্মৃতিময়। যদিও একটা সময় ছিল লাঙল-গরুর হালচাষ ব্যতীত জমি প্রস্তুতের কথা চিন্তাই করা যেত না। 

যশোরে তেমন একটা চোখে পড়ে না গরু দিয়ে হাল চাষের দৃশ্য। এক সময় এ অঞ্চলের ফসলি মাঠে মাঠে গরু দিয়ে হালচাষের দৃশ্যে গ্রামবাংলার চিরচেনা রূপ ফুটে উঠত। সময়ের পরিক্রমায় আর আধুনিক চাষযন্ত্রের বদৌলতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীনকাল থেকে জমি আবাদে চলে আসা গ্রামবাংলার ঐতিহ্য গরু-লাঙল দিয়ে হালচাষের চিত্র। 

আদিকাল থেকেই কৃষি কাজে ব্যবহার হতো এই হালের লাঙল ও মই। বিশেষ করে, নদীমাতৃক বঙ্গ অঞ্চলে সুদীর্ঘকাল ধরে চাষাবাদের মূল হাতিয়ার হিসেবে এগুলোই ব্যবহৃত হত। বাঙালি গৃহবধূরা শাড়ি পরে কোমরে খাবারের গামলা আর হাতে পানির ঘটি নিয়ে সকাল হলেই মাঠের আঁকা-বাঁকা মেঠপথ ধরে যেত। সেখানেই অনেকে ভাগাভাগি করে সেই খাবার খেতেন। 

লাঙল-জোয়াল নিয়ে কৃষকরা কাক ডাকা ভোর থেকেই মাঠের প্রান্তরে হালচাষ করত। এ চাষের ক্ষেত্রে গরুর হাল, মই, একজন মানুষ ও সাথে একজোড়া গরু অথবা মহিষ থাকত। কালের বিবর্তনে যান্ত্রিক চাষাবাদ পদ্ধতির সহজলভ্যতায় মানুষের হাল চাষের সেই আগ্রহে এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে। যদিও এখনো কিছু এলাকায় শীতকালীন সবজি চাষাবাদ, নিচু জমি কিংবা মৌসুমি চাষাবাদে লাঙল-জোয়ালই মূল হাতিয়ার হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ, সবজি খেতে ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করলে মই দিয়ে সমান করা যায় না। আবার জমিতে সারিবদ্ধভাবে চারা লাগাতে লাঙ্গলের ব্যবহার করতে হয়।

 

অন্যদিকে, কালের আবর্তে আধুনিকতার যুগে যান্ত্রিকতা নির্ভর যন্ত্র দিয়ে জমি চাষের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে দিন-কে-দিন গ্রাম বাংলার এ ঐতিহ্য অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনকি, বর্তমানে গ্রামীণ সমাজের অনেক চাষিই গরু পালন ছেড়ে দিয়েছে। আবার অনেকেই বাপ-দাদার সেই পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু হাল চাষের জন্য তাদের এখন খুব একটা কেউ ডাকে না বল্লেই চলে। 

গরু-লাঙল দিয়ে হালচাষ বিষয়ে স্থানীয় এক চাষি বলেন, “পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রেখেছি। হাল চাষের জন্য এক জোড়া বলদ গরু, লাঙল-জোয়াল, মই, ছড়ি, গরুর মুখের টোনা লাগে। গরুর লাঙল দিয়ে মাটির গভীরে গিয়ে মাটি তুলে উল্টিয়ে রাখে। ওপরের মাটি নিচে পড়ে আর নিচের মাটি ওপরে। এতে জমিতে ঘাস কম হয়, আর হাল চাষের সময় গরুর গোবর সেই জমিতেই পড়ে। এতে একদিকে যেমন জমিতে জৈব সারের চাহিদা পূরণ হয়, তেমনি ফসলও ভালো হয়।” 

স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ক সময় গরু দিয়ে হাল চাষ ছাড়া ফসল আবাদের আর কোনো উপায় ছিল না। তাই প্রতিটি গৃহস্থ পরিবারে ছিল হালচাষ উপযোগী গরু, লাঙল, জোয়াল ও মই। এগুলো ছাড়া কোনো গৃহস্থ পরিবার কল্পনাই করা যেত না।

কৃষিতে আমূল পরিবর্তন ও আধুনিক চাষ যন্ত্রের ব্যবহার প্রান্তিক কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছার কারণে দিন দিন গৃহস্থ পরিবারেও এসেছে পরিবর্তন। এখন আর গৃহস্থ পরিবারে সেই চিত্র নেই। ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলারের প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে। কম সময়ে বেশি জমিতে চাষে সক্ষম হওয়ায় জমির মালিকরা এটা দিয়েই জমি চাষ করছে। যে কৃষকরা গরু দিয়ে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত কালক্রমে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব হোসেন জানান, এক সময় এ জনপদের ফসলি মাঠের দিকে নজর পড়তে দেখা যেত গরু-লাঙল দিয়ে হাল চাষের দৃশ্য। এখন হাল চাষের জন্য মেশিন বেরিয়েছে। যাতে অল্প সময়ে বেশি জমি চাষ করা যায়। ফলে দিন দিন গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হালচাষের এ পদ্ধতি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, একটা সময় গরু-লাঙল ছাড়া জমি চাষের কথা চিন্তাই করা যেত না। যদিও এখন সময় অনেক পাল্টে গেছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত করতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

ঢাকা/প্রিয়ব্রত/ইমন


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়