‘আ. লীগের একটারে খেয়ে ফেলেছি, দেখি কারা উদ্ধার করতে আসে’
অভয়নগর (যশোর) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
নওয়াপাড়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জিয়া উদ্দিন পলাশ
“আওয়ামী লীগের একটারে খেয়ে ফেলেছি, দেখি কারা উদ্ধার করতে আসে!”
যশোরের অভয়নগরে নওয়াপাড়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জিয়া উদ্দিন পলাশকে হত্যার পর এভাবেই প্রকাশ্যে চিকিৎকার করছিল রইস সিকদার ও তার সহযোগীরা।
রইচ সিকদার উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের সিদ্দিক সরদারের ছেলে। তিনি নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির প্রচার সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি নওয়াপাড়া পৌর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাত ১০টার দিকে উপজেলার বেঙ্গল রেলগেট-সংলগ্ন সাইদুর রহমান ঘাটের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে পলাশের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মরদেহ উদ্ধারের আগে রইস সিকদার (৩৮) ‘আওয়ামী লীগের একটারে ফেলে দিয়েছি’ বলে চিৎকার করছি। মরদেহ উদ্ধারের পর রইসকে ধাওয়া দিয়ে ধরে গণধোলাই দেয় এলাকাবাসী। তবে সেখান থেকে তার সহযোগীরা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
জিয়া উদ্দিন পলাশের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আনতে যাওয়া জিহাদ ও সোহাগকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ।
পলাশের পরিবারের অভিযোগ, অপহরণের পর পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে।
এই ঘটনায় হতবাক মানুষ, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়।
নিহতের স্ত্রী শারমিন নাহার রত্না বলেন, ঘটনার দিন শনিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় তেতুলতলা জামে মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বড় ছেলে তাহসিন (১০) ও ৯ মাস বয়সি ছোট ছেলে তাইফকে আদর করে যান তার স্বামী (পলাশ)। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রইস সিকদারের সহযোগী জিহাদ ও সোহাগ বাড়িতে আসে। তারা বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে পলাশের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতে বলেন। এসময় মোবাইলে কথা হলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে পলাশ বলেন, তাকে অপহরণ করা হয়েছে।
“যেভাবে সম্ভব ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে ওই দুই ছেলের কাছে দিয়ে দাও। তা না হলে এরা আমাকে খুন করবে বলে মারপিট শুরু করেছে।”
এ সময় রত্না তার স্বামীর কাছে জানতে চান, তোমাকে কোথায় রাখা হয়েছে। তখন অপরপ্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেওয়া হয় বলে তথ্য দিয়েছেন রত্না।
রত্নার দাবি, “পরিকল্পিতভাবে অপহরণের পর আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।”
হত্যার শিকার পলাশ নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ওই ওয়ার্ডের নওয়াপাড়া মডেল কলেজ-সংলগ্ন মৃত ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। আটক রইস সিকদার একই ওয়ার্ডের রেলবস্তির সিদ্দিক শিকদারের ছেলে। হত্যাকারীরা স্থানীয় ওয়ার্ড বিএনপির কর্মী বলে একাধীক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নিহতের ছোট ভাই আব্দুল মান্নান লেলিন বলেন, “২০০৩ সালের ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নওয়াপাড়া রেলস্টেশন এলাকায় তাদের বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তাদের বাবাও তখন নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডেরই কমিশনার ছিলেন। বাবার হত্যার বিচার আজও মেলেনি।”
“এবার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী রইস সিকদার তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে বড় ভাই পলাশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। প্রথমে অপহরণ, তারপর টাকা নিয়ে ভাইকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে পরিত্যক্ত ঘরের ভেতর ফেলে রেখেছির। বাবা হত্যার বিচার মেলেনি, ভাই হত্যার বিচার মিলবে কি?” এমন প্রশ্ন করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
তেতুলতলা জামে মসজিদের মুসল্লীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মাগরিবের নামাজ শেষে সাবেক কাউন্সিলর পলাশ মসজিদ থেকে বেরিয়ে নওয়াপাড়া রেলস্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। এসময় একটি ভ্যানে রইস সিকদার, রবি, জিহাদ ও সোহাগ পলাশকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। পরে জানতে পারি পলাশকে অপহরণের পর পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যা অত্যান্ত দুঃখজনক।
অভয়নগরের মধ্যে নওয়াপাড়া পৌরসভা এলাকাটি শিল্পবাণিজ্য নগরী ও নদীবন্দরের জন্য সব সময় আলোচনায় থাকে।
পলাশ হত্যাকাণ্ডের পর সন্ত্রাসীদের আতঙ্কে কেউ কথা বলতে চাইছে না। অনেকের অভিযোগ, পলাশ হত্যার সঙ্গে জড়িত এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা গত ৫ আগস্টের পর থেকে বেপরোয়া। তাদের নির্যাতন ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে হামলা ও মারপিটের শিকার হতে হয়। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদও করতে পারছে না।
এলাকাবাসী ও পলাশের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পলাশ নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানার পর খোঁজাখুজি শুরু হয়। খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে রাত ১০টার দিকে নওয়াপাড়ার বেঙ্গল রেলগেটে লোকজন পৌঁছলে রইস ও তার সহযোগীরা চিৎকার করে বলে, “আওয়ামী লীগের একটারে খেয়ে ফেলেছি, দেখি কারা উদ্ধার করতে আসে।”
সেসময় বেঙ্গল রেলগেটের পাশে সাইদুর রহমান ঘাটের একটি পরিত্যক্ত ঘরের ভেতর রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় পলাশের সন্ধান মেলে। দ্রুত উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এরপর উত্তেজিত এলাকাবাসী রইসকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। এসময় তার সহযোগীরা দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।
রাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. শোভন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মৃত অবস্থায় সাবেক কাউন্সিলর পলাশের মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়। দেখে মনে হয়েছে, নিহতের শরীরে লাঠি দিয়ে পেটানো ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। অতিরিক্ত আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমাদুল করিম বলেন, সাবেক কাউন্সিলর জিয়া উদ্দিন পলাশকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে রইস সিকদার নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে। গণধোলাইয়ের শিকার ওই যুবককে পুলিশ হেফাজতে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নিহতের পরিবার থেকে মামলা দায়ের করা হয়নি। মামলা দায়েরের পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যান্য অপরাধীদের ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) মাগরিবের নামাজ শেষে তেতুলতলা জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে নিহত জিয়া উদ্দিন পলাশের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
ঢাকা/প্রিয়ব্রত/রাসেল