ঢাকা     শুক্রবার   ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ১৯ ১৪৩১

নোয়াখালীতে স্মরণকালের বন্যা : দায়ী অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা

মাওলা সুজন, নোয়াখালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৩:১০, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
নোয়াখালীতে স্মরণকালের বন্যা : দায়ী অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা

এ বছরের নোয়াখালীর বন্যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এমন বন্যা জেলার ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। নোয়াখালীর প্রবীণরাও বলছেন আর কখনো এমন প্লাবন দেখেননি তারা। এটাই তাদের চোখে দেখা জেলার সবচেয়ে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। 

এরআগে দু’একবার ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে জলাবদ্ধতা হলেও তা বন্যায় রূপ নেয়নি বা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু এবারের বন্যায় জেলার অতীতের সবকিছুকে ছাপিয়ে দেশে কয়েকদিনের জন্য সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। সারা দেশের নজর ছিলো নোয়াখালীর দিকে। আর তাই সারা দেশ থেকে মানবিকভাবে আপামর জনতা যে যার মতো করে ছুটে এসেছিলেন নোয়াখালীতে। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহমর্মীতা ও সহযোগীতার হাত। সারা দেশ দু’হাত ভরে দিয়েছে নোয়াখালীকে। তাই নোয়াখালীবাসীও কৃতজ্ঞ দেশবাসীর কাছে। 

জেলার অনেকেই মনে করছেন এ বন্যার জন্য দায়ী প্রশাসন। কারণ ভারী বৃষ্টিপাত শুরুর সাথে সাথে যখন জলাবদ্ধতা শুরু হয় তখন প্রশাসন সে দিকে নজর দেয়নি। ফলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে তা বন্যায় রূপ নেয়। প্রশাসন যদি সময় মতো উদ্যোগ নিতো তাহলে বন্যার ভয়াবহতা কম হতো। বিভিন্ন উপজেলার পানি নিষ্কাশনের পথগুলো যদি সচল থাকতো তাহলে বন্যার স্থায়ীত্ব কম থাকতো।

আরো পড়ুন:

নোয়াখালীর ৯টি উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলাই কমবেশি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সদর, বেগমগজ্ঞ, চাটখিল ও সেনবাগ উপজেলা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার শুরুর সাথে মানুষজন চেষ্টা করেছে বসতবাড়িতে থাকার জন্য। কিন্তু পানি বাড়ার সাথে সাথে আর না পেরে বাধ্য হয়ে আশপাশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও উঁচু ভবনে আশ্রয় নেয়। জেলাতে প্রায় ২১ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়েছিলো। জেলার উচ্চবিত্তরাও এবার বন্যার কবলে পড়েছিলেন।

বন্যার শিকার হওয়া মানুষদের সাথে বথা বলে জানা গেছে, নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার যে বড় বড় খালগুলো দিয়ে বৃষ্টি অথবা বন্যার পানি মেঘনা নদীতে যায়, সেসব খালের বিভিন্ন মুখ ও জায়গা দখল করে রেখেছিলো প্রভাবশালীরা। ¯øুইসগেট বা রেগুলেটরসহ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খালের উপর এবং এর দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছিলো অবৈধ স্থাপনা।

আগষ্ট মাসে হয়ে যাওয়া এই বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জেলার কৃষি, মৎস্য, সড়কসহ বিভিন্ন খাতে।

জেলার মৎস অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় জেলাতে প্রায় ৮৫ হাজার মাছের ঘের, প্রজেক্ট তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকার মতো। পথে বসতে হয়েছে ধার দেনা করে চাষ করা মৎস্য ব্যবসায়ীদের। এছাড়া অনেক উদ্যোগক্তাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৮ হাজার ৪৫৬ হেক্টর ফসলের মাঠ। বীজতলা নষ্ট হয়েছে ৪৫০০ শত হেক্টর।  যার মধ্যে ৩৪ হাজার হেক্টর জমির আউশ রোপা আমন ও আমনের বীজতলা আক্রান্ত হয়। আমন ও আউশের উৎপাদন ৮২ হাজার ৫৮৯ মেট্রিক টন কমতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ। ফলে ঋণ নিয়ে  চাষ করায় কৃৃষকরা পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা অনেকেই।  

জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নোয়াখালীতে বন্যায় জেলার প্রায় ২০০০ কিলোমিটারের মতো সড়কের ক্ষতি হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। যা দিয়ে পুরো জেলার গ্রামীণ সড়ক মেরামত করা সম্ভব না।

জেলা সড়ক বিভাগের তথ্য মতে, বন্যায় পানির নিচে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ২০০ কিলোমিটার সড়ক। যার অর্থিক পরিমাণ ২০ কোটি টাকার উপর।

নোয়াখালী পৌর এলাকায় প্রায় ৪১ কিলোমিটার রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মাত্র ১০ কিলোমিটার রাস্তার বরাদ্দের আশ্বাস পেয়েছেন পৌর কর্তৃপক্ষ।

নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল জানান, নোয়াখালীতে আগে বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য শত শত দীঘি খনন করা হয়েছিল। পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল। ছিল নোয়াখালী, বেগমগঞ্জের অবদা খাল, ভুলুয়া খালসহ ছোট বড় অসংখ্য খাল। এই খালগুলোর মধ্যে যে আন্তঃসংযোগ ছিল সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন জায়গায় দখল নিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভাটির পানি খাল বেয়ে নেমে যাওয়ার আর পথ নেই। আজকের যে নোয়াখালীর মাইজদী শহর, সেটিও গড়ে উঠেছে খালের ওপর। ওই খালটির নাম ছিল ছাগলমারা খাল। এর পাশেই ছিল নোয়াখাল।

নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল জানান, এবারের বন্যায় নোয়াখালীতে পানির নামার গতি ছিলো খুবই কম। জেলার চাটখিল, সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ ও সদর উপজেলার পানি লক্ষীপুর জেলার রহমতখালী খালের মাধ্যমে রহমতখালী রেগুলেটর হয়ে মেঘনা নদীতে পড়ে। কিন্তু রহমতখালী খালের লক্ষীপুর অংশ দীর্ঘদিন ধরে খনন করা হয়নি। যে কারণে আবর্জনা জমে খালের নাব্যতা কমে গেছে। ফলে পানি নেমেছিলো ধীরে। আর তার কারণেই ভোগান্তিও হয়েছে দীর্ঘতর।

প্রকৌশলী আমির ফয়সাল জানান, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নোয়াখালী সদর, কবিরহাট ও বেগমগঞ্জ উপজেলায় ১৬১ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়। এছাড়া ১৯৬৪ সালে সদর উপজেলার মান্নাননগর থেকে আটকপালিয়া (হারিছ চৌধুরীর বাজার) পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এলাকায় ক্রস ড্যাম নির্মাণ করা হয়। এর ফলে সুবর্নচর উপজেলার ৭১ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পেলেও ক্রসড্যামের কারণে সুবর্নচর উপজেলা সদর উপজেলার চেয়ে উঁচু ভূমিতে পরিণত হয়। ফলে সদরের পানি বের হওয়ার পথ কঠিন হয়ে যায়।

পার্টিসিপারি ফর রিচার্স অ্যান্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক (প্রান) এর প্রধান নির্বাহী নুরুল আলম মাসুদ বলেন, “বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীন জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বন্যার ভয়বহতায় তাদের শুধু ঘর-বাড়ী নয়, রান্নাঘর-গোয়ালঘর পর্যন্ত পানিতে সয়লাব হয়েছে। ফলে তারা বাধ্য হয়েই যে যার মতোর করে আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। এবিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ছিলো আশ্চর্যজনক বিষয়। তারা মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য কোনো প্রকার সাহায্য তো দূরে, ন্যুনতম সহযোগীতাও করেননি। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পর আশ্রিতরা পড়েছিলেন আরেক বিড়ম্বনায়। বিশেষ করে রান্না করা খাওয়ারের ছিলো সংকট। বাইরের এবং স্থানীয়ভাবে সাহায্য করা শুকনো খাবার ছিলো তাদের ভরসা। 

এছাড়া বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এসব অঞ্চলের আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আর তা হলো সেনিটেশন ব্যবস্থা। বন্যায় সেনিটেশনের কাঠামো একেবারেই ভেঙে গিয়েছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এবিষয়ে কাজ করছি। যাদের সেনিটেশন ব্যবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর তাদের তালিকা করে সেটি তৈরি করে দিচ্ছি।”

তিনি বলেন, “এবারের বন্যায় সরকারি সহায়তা ছিলো ভীষণ অপ্রতুল। স্থানীয় প্রশাসনের নিলিপ্ততা ছিলো অবাক করার বিষয়। বাইরের অন্যান্য জেলা থেকে যদি সাহায্য না আসেতো তাহলে নোয়াখালীতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতো।”

নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, “ভৌগলিকভাবে নোয়াখালী নিচু এলাকা। এখানে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এবার ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হয়েছে। আগামীতে কিভাবে এটি রোধ করা যায়, তার জন্য প্রশাসন কাজ করছে। আশা করি সুফল নোয়াখালীবাসী পাবে।”

ঢাকা/টিপু

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়