ঢাকা     শনিবার   ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২০ ১৪৩১

যানজটে নাকাল বগুড়াবাসী

এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১০:২৭, ১ জানুয়ারি ২০২৫
যানজটে নাকাল বগুড়াবাসী

বগুড়া শহরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে সব ধরণের ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা। এরসঙ্গে শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় রাস্তার দু’পাশে ফুটপাত দখল করে হকারদের দোকান ও অবৈধভাবে মোটরসাইকেল এবং গাড়ি পার্কিং শহরকে ভয়াবহ যানজটের কবলে ফেলছে। ফলে বাড়ি থেকে বের হয়ে শহরে প্রবেশ করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বগুড়াবাসীকে।

যানজট নিরসন এবং রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে বসা হকারদের উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশ হাতে গোনা কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে তাদের সেই উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। এরপর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি তাদের। ফলে যানবাহনে চড়ে ও পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছা কঠিন হয়ে পড়েছে। যানজট নিরসন আর ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নতুন পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

জানা গেছে, প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বগুড়া শহরে বাড়তে শুরু করে যানজটও। সকাল ১০টার পর শহরের গোহাইল রোডের সূত্রাপুর থেকে সাতমাথা, শেরপুর রোডের মফিজ পাগলার মোড় থেকে সাতমাথা, দত্তবাড়ী থেকে সাতমাথা, ফতেহ আলী বাজার থেকে থানা মোড় পর্যন্ত তীব্র যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। এছাড়া বাদুরতলা এলাকায় ট্রান্সপোর্ট/কুরিয়ার সার্ভিস থাকায় বড় কার্গো গাড়ি সারাদিন ওই এলাকায় প্রবেশ করে। দিনের বেলায় এই গাড়িগুলোর একটি ওই এলাকায় প্রবেশ করলেই যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট মুক্ত হতে সময় লাগে অন্তত ৪০ মিনিট। 

আরো পড়ুন:

একই অবস্থা পার্ক রোডেরও। সরু এই রোডেও একটি কুরিয়ার সার্ভিস থাকায় দিনে কয়েকবার তাদের ব্যক্তিগত বড় আকারের মালবাহী গাড়ি প্রবেশ করে এবং বের হয়। গাড়িগুলো প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। যেটি নিরসন হতেও সময় লেগে যায় দীর্ঘক্ষণ।

টিনপট্টি এলাকায় দিনের বেলায় রড সিমেন্ট এবং টিনের ট্রাক থেকে মাল লোড-আনলোড করা হয়। এই রাস্তাটি সরু হওয়ায় একটি বৃহৎ আকারের ট্রাক প্রবেশ করলেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যেটা নিরসনে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়। এভাবে একের পর এক মালবাহী ট্রাক প্রবেশ করায় দিনের পুরোটা সময়ই যানজট লেগে থাকে টিনপট্টি এলাকায়।

বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার প্রায় সবগুলো সড়কই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, অবৈধ পার্কিং, রাস্তার দু’পাশে বসা দোকানের কারণে যানজটের কবলে পড়ে থাকে। ফলে ব্যস্ত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে কয়েক দফা যানজটে ঘণ্টারও বেশি সময় চলে যায়! এমনকি, ফুটপাত দখল করে বসা দোকানিদের কারণে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতেও স্বস্তি নেই এই শহরে।

এলাকাবাসী জানান, বগুড়া শহরে যানজটের অন্যতম কারণ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব অটোরিকশার চালকরা মানছেন না কোনো ট্রাফিক আইন। যত্রতত্র তারা গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করান। অনেক সময় অটোরিকশার ধাক্কায় সড়কে অনেকেই আহত হন। 

এদিকে, বিকেল হলেই সাতমাথা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ভাজি-পুরিসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। ভ্রাম্যমাণ শীতের পোশাক বিক্রেতারাও তাদের ভ্যান নিয়ে হাজির হন শহরে। এসব দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়। ফলে সাতমাথার মুক্তমঞ্চের সামনে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। ফলে ওই স্থান দিয়ে শহরের টেম্পল রোড, গালাপট্টিতে পায়ে হেঁটে চলাচলও প্রায় অসাধ্য। কাঁঠালতলা এলাকার অবস্থা আরো বাজে। রাস্তার দুই পাশে বসা দোকানগুলোর কারণে সবসময় সেখানে যানজট লেগেই থাকে।

বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী মাহমুদ সোহেল জানান, তিনি প্রতিদিন অটোরিকশাতে করে মাটিডালি থেকে সাতমাথা পর্যন্ত যান। এরপর সেখান থেকে অটোরিকশা পরিবর্তন করে পলিটেকনিকে যান। মাটিডালি থেকে সাতমাথা যেতে ১০ মিনিটের মতো সময় লাগার কথা। তবে যানজটের কারণে বড়গোলা পর্যন্ত পৌছতেই আধাঘণ্টারও বেশি সময় লাগে তার। সাতমাথা পৌছতে আরো ১০ মিনিট সময় লাগে তার।

মোটরসাইকেলে সাতমাথা হয়ে কলোনির দিকে যাওয়া চন্ডিহারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহিনুর রহমানকে বড়গোলা মোড়ে যানজটে আটকে থাকতে দেখা যায়। কথা হলে তিনি বলেন, “একমুখী রাস্তা হওয়ার কারণেই বগুড়ায় যানজট হচ্ছে। যদি বিকল্প রাস্তা থাকতো তাহলে এরকম যানজট সৃষ্টি হত না। যানজট নিরসনে এই উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।”

সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আতোয়ার হোসেন বলেন, “রিকশায় চড়ে গন্তব্যে যেতে চাইলে যানজট আর পায়ে হাঁটতে গেলে ভীতি কাজ করে। কারণ চালকরা বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালান। অনেক সময় তারা রিকশা শরীরে উঠিয়ে দেয়।”

পথচারী অংশু মোস্তাফিজ বলেন, “গত কয়েক মাসে শহরে যানজটের পরিমাণ খুব বেড়েছে। যেখানে যাই সেখানেই গাড়ি আর গাড়ি। সব মিলিয়ে গোলমেলে অবস্থা। সড়কের এপার থেকে ওপার যেতে হলে রিকশার সঙ্গে ধাক্কা খেতে হয়। ফুটপাতে চলাচলের ব্যবস্থাও খুব নাজুক। এগুলো ঠিক করা দরকার। বৃহৎ স্বার্থে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য।”

অটোরিকশা চালক নজরুল ইসলাম বলেন, “যানজটের কারণে কালীতলা থেকে সাতমাথা পৌঁছতেই আধাঘণ্টা সময় লাগে। যেখানে পৌঁছাতে সময় লাগার কথা ১০ মিনিট সেখানে পৌঁছাতেও আধাঘণ্টার মতো সময় লাগছে। ছয় সিটের অটোরিকশা বেশি শহরের মধ্যে চলাচল করছে, যে কারণে যানজট বেড়েছে। যানজটের কারণে শহরের ভেতরে যাত্রীরা আগের মতো রিকশায় উঠছেন না। তারা পায়ে হেঁটে চলাচল করছেন। প্রায় ৫ মাস হলো এই অবস্থা চলছে।” 

বগুড়ার সাংবাদিক নেতা প্রতীক ওমর বলেন, “বগুড়া শহরে কয়েকটি কারণে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি এখানে কোনো নগর পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। নগর পরিকল্পনাবিদ যারা রয়েছে, তাদের এই শহর নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনাই নেই। তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব আমরা এখানে দেখতে পারি। দ্বিতীয় কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের শহরের প্রতি, রাস্তার প্রতি দরদ কম। তারা যদি এদিকে নজর দিতেন, তাহলে বিষয়টি নিয়ে তারা চিন্তা করতে পারতেন। একটা উদ্যোগ নিতে পারতেন। সেটা কাজে লাগতে পারতেন যানজট নিরসনে। সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি। তৃতীয় কারণ, এটি পৌরসভার একটি অংশ, শহরটা পৌরসভার।” 

তিনি আরো বলেন, “ট্রাফিকের সঙ্গে পৌরসভার সমন্বয় আমরা কখনই দেখিনি। শহরে যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এটা নিয়ে যদি পৌরসভা, ট্রাফিক ও প্রশাসন যদি না ভাবে তাহলে দিনদিন বগুড়া অবাসযোগ্য একটা শহরে পরিণত হবে।”

বগুড়া ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (প্রশাসন) মো. সালেকুজ্জামান খান বলেন, “শহরের ভেতরে কি পরিমাণ যানবাহন ৫ আগস্টের পর প্রবেশ করেছে তা নির্ণয় করা হয়নি। গত ৫ বছর আগে আমরা বগুড়া শহরকে যেভাবে দেখেছিলাম, সেই বগুড়া শহর কিন্তু এখন আর নেই। শহরের ভেতর মোটা চাকার ইজিবাইক, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, চিকন চাকার অটোরিকশা ব্যাপক হারে বেড়েছে। আমরা যানজট কমিয়ে আনতে কাজ করছি।” 

তিনি আরো বলেন, “একদিকে প্রচুর গাড়ির চাপ, অন্যদিকে ফুটপাত দখল করছেন হকাররা। যানজট নিরসনে আমাদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। আমার মনে হয়, ইজিবাইকগুলো ইয়াকুবিয়া মোড়, ঘোড়াপট্টি, বড়গোলা অতিক্রম করতে দেওয়া যাবে না। মোট কথা সাতমাথায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া আমরা পারছি না। পাশাপাশি ফুটপাত দখলের বিরুদ্ধে আমরা যখন কাজ করছি তখন হকাররা সেখান থেকে চলে যাচ্ছেন। আমরা সরে আসার পরই তারা আবারো ফুটপাত দখল করছেন। অনেককে ধরে নিয়ে আসছি। মুচলেকা নিয়ে আবার ছেড়েও দিচ্ছি। আসলে আইন মানছেন না তারা। যানজট নিরসনে তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আইন মানতে হবে।” 

ট্রাফিক পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, “ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে ভালো রাখার জন্য আমরা যে দিক নির্দেশনাগুলো দেব এগুলো মানতে হবে। ফুটপাত থেকে হকার মুক্ত রাখতে আমরা যে নির্দেশনাগুলো দিচ্ছি সেগুলো সবাইকে মানতে হবে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, বিআরটিএ এবং পৌরসভাকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমেই আমরা মনে করি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”

বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, “আমরা দেখেছি, বগুড়া শহরের যানজট শুধুমাত্র সাতমাথা কেন্দ্রিকই। সাতমাথা থেকে বড়গোলার দিকে যানজট আরো বেশি। সাতমাথার যানজট নিরসনের জন্য আমাদের এখানে যে হকার আছেন যারা ফুটপাতের ওপর আবার ফুটপাত থেকে নেমে মূল রাস্তার মধ্যেও দোকান করছেন তাদের উঠিয়ে দিতে আমাদের মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও কাজ করেছে।” 

তিনি বলেন, “পরপর দুই সপ্তাহ এই কাজটি করা হয়েছে। তবে, দেখা যায় হকারদের উঠিয়ে দিয়ে আসলাম পরে তারা আবারও বসছে। ফলে যে অবস্থা ছিল সে অবস্থাই থেকে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছে, আমরা জায়গা দেখছি যেখানে তাদেরকে দেওয়া যায়। লিংক রোড খুলে দেওয়ার জন্য আমরা পৌরসভার সঙ্গে কথা বলেছি এবং একটি কমিটি করেছি। ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, আমাদের একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং পৌরসভার সমন্বয়ে কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি লিংক রোডটা দেখবে। সেই ক্ষেত্রে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে।” 

জেলা প্রশাসক বাড়তি যানবাহনের বিষয়ে বলেন, “ইজিবাইকসহ অটোরিকশা যেগুলো আছে এগুলোর তো লাইসেন্স দেওয়া যায় না আইনগত কারণেই। অটোরিকশার বিষয়ে আমি যেটা বলেছি পৌরসভাকে, তারা একটি সংখ্যা নির্ধারণ করবে। বগুড়া পৌরসভার ধারণ ক্ষমতা কতো সেটি নির্ণয় করবে এবং দুটো ভিন্ন রং করে দিন এবং রাত হিসেবে আলাদা করবে যে কোনটা দিনে চলবে আর কোনটা রাতে চলবে। কমিটিকে আগামী আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ের আগেই তাদের কর্ম পরিকল্পনা দেখাতে বলেছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়