আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুদকের অভিযান
বাদল সাহা, গোপালগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের অভিযান
আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে এবং অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে তিন কিলোমিটার এইচবিবি (ইট বিছানো) সড়ক ও তিনটি খালের উপর তিনটি ব্রিজ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন না করেই বিলের সমস্ত অর্থ উত্তোলন করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় জেলা পরিষদে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও মিলেছে।
বুধবার (১ জানুয়ারি) সকালে দুর্নীতি দমন কমিশন গোপালগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-পরিচলক মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল এ অভিযান পরিচালনা করেন।
সরেজমিনে গিয়ে ও জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের মাঝকান্দি গ্রামের মাঝকান্দি-খাগড়াবাড়িয়া সড়কের তিনটি খালের উপর এলাকাবাসীর যাতায়াত দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ২০১৫ সালের শুরুতে গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ তিনটি ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ওই বছরই টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে জেলার কাশিয়ানী উপজেলার মেসার্স হাবীব এন্ড কোং নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
এই কাজে প্রথম বিল পরিশোধ করা হয় ৫৪ লক্ষ ৭ হাজার ২১৭ টাকা এবং দ্বিতীয় বিল পরিশোধ করে ২৬ লক্ষ ১২ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঠিকাদারের রক্ষিত জামানত ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ৭২১ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এই কাজের মূল্য নির্ধারণ ছিল ৯০ লক্ষ টাকা। মেসার্স হাবীব এন্ড কোং নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেলেও আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে কাজটি করেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম।
তবে ২০১৭ সালে তিনটি ব্রিজের অ্যাপ্রোচ নির্মাণ না করে জনগণের যাতায়াত ব্যবস্থা না করেই কাগজে-কলমে কাজ শেষ করা হয় প্রকল্পের কাজ। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো উপকার না হলেও তদারকী প্রকৌশলীদের পকেটে লাখ লাখ টাকা গেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
পরবর্তীতে স্থানীয় বাসিন্দারা একটি ব্রিজে ওঠানামা করার জন্য বাঁশের মই তৈরি করে ব্যবহার করে আসছে। এতে বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে। অপর দুটি ব্রিজের অ্যাপ্রোচে স্থানীয় ওড়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান ৪০ দিনের সৃজনশীল কর্মসূচির শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে লোকজনের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তবে অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে মেসার্স হাবীব এন্ড কোং নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান থেকে কাজটি বাগিয়ে নেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। কাজ শেষ না করেই জেলা পরিষদের কর্মকর্তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আওয়ামী লীগের প্রভাব দেখিয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করিয়ে বিল তুলে নেন।
এমনকি অ্যাপ্রোচ সড়ক না করলেও জামানতের পুরো টাকা তুলে নেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় স্বাক্ষর করাসহ বিল দিতে বাধ্য হন কর্মকর্তারা।
এদিকে, অভিযোগের ভিত্তিতে, আজ বুধবার সকালে দুর্নীতি দমন কমিশন গোপালগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-পরিচলক মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল জেলা পরিষদে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান পরিচালনাকালে ফাইলপত্র যাচাই বাছাই করে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মেলে।
মাইজকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম তালুকদার ও মো. হাসন মোল্লা জানান, গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে আড়কান্দি ব্রিজ হতে মাইজকান্দি হয়ে আড়ুয়াকান্দি খাল পর্যন্ত তিনটি ব্রিজসহ এইচবিবি রাস্তা নির্মাণ করা হয়। কাজের মান একেবারেই ভালো ছিল না, এলাকাবাসী বারবার এর প্রতিবাদ করেও সুফল পাননি। জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী মো. আনিচুর রহমান কাজ বুঝে নিয়েছেন। সেসময়ে তারা বলেছেন ব্রিজে ওঠার ব্যবস্থা করা হবে কিন্ত করেননি। ঠিকাদার গোপালগঞ্জ শহরের প্রভাবশালী লোক হওয়ায় কেউ ভয়ে কিছু বলতেও পারেনি।
একই গ্রামের মো. বেল্লাল খান ও মিতা বেগম বলেন, “এ ব্রিজ পারাপার হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের দাবি, গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ প্রশাসক বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করিয়ে আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা করে দেবেন।”
ওড়াকান্দি স্কুলের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরাজুল তালুকদার বলে, “বর্ষা মৌসুমে আমাদের স্কুলে যেতে সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক সময় স্কুলে যেতে পারি না। আমাদের দাবি যেন সড়কটি করে দেওয়া হয়।”
স্থানীয় ওড়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান বদরুল আলম বিটুল বলেন, “আমার ইউনিয়নের মাইজকান্দি-খাগড়াবাড়িয়া সড়কে ওড়াকান্দি খালের উপর জেলা পরিষদ তিনটি ব্রিজ নির্মাণ করেছে ২০১৭ সালে। ব্রিজগুলির অ্যাপ্রোচ না করেই কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করেছে অফিস। যে কারণে ওই এলাকার বাসিন্দারা দীর্ঘ ৯ বছর ব্রিজটি ব্যবহার করতে পারছে না।”
“আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০ দিনের সৃজনশীল কর্মসূচির লেবার দিয়ে দু’টি ব্রিজের অ্যাপ্রোচে মাটি দিয়ে জনগণের হাঁটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। অন্যটিতে গ্রামবাসী বাঁশের মই লাগিয়ে ওঠানামা করে। আমার দাবি দ্রুত ব্রিজ তিনটির অ্যাপ্রোচ নির্মাণ করে জনগণের যাতায়াতের সুবিধা সৃষ্টি করা হোক” বলেন তিনি।
জেলা পরিষদের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন বলেন, “যে সময় ব্রিজের কাজ হয় তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। ব্রিজের কাজ করেছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। তিনি ব্রিজের কাজ শেষ না করে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্রের মুখে ফাইলে সই করিয়ে অর্থ তুলে নেন।”
এদিকে ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। এ কারণে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যলয়ের উপ-পরিচলক মো. মশিউর রহমান বলেন, “গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের মাইজকান্দি থেকে আড়কান্দি গ্রাম পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এইচবিবি (ইট বিছানো) সড়ক ও তিনটি খালের উপর তিনটি ব্রিজ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন না করে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও ঠিকাদার বিলের সমুদয় অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে বলে অভিযোগ ওঠে। পরে আজ অভিযান চালিয়ে ফাইলপত্র যাচাই বাছাই করে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হবে এবং পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেছেন, “আমি এ ব্যাপারে সরজমিনে পরিদর্শন করে জনগণের যাতায়াত সুবিধার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যেন ওই এলাকার জনগণের যাতায়াতে আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়।”
ঢাকা/সনি