ঢাকা     বুধবার   ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৪ ১৪৩১

খুলনায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ৬ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৯:৪৩, ৬ জানুয়ারি ২০২৫
খুলনায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক

খুলনা নগরীতে সন্ধ্যা নামলে প্রতিনিয়ত হামলা ও খুন-জখম হচ্ছে। মাত্র তিন মাসে নগরী ও জেলায় আটটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসীদের মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সরকার পতন হয়। এ আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর মানুষের ক্ষোভ এবং সহিংসতার প্রেক্ষাপটে পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়ে। এ সুযোগে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতি রাতে নগরীর কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসীদের মহড়া চলছে। গুলি করে কিংবা কুপিয়ে হতাহত করা হচ্ছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩ মাসে নগরীসহ খুলনা জেলায় সন্ত্রাসীরা আটজনকে খুন করেছে। 

গত ৯ ডিসেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতা নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। মাদক বিক্রি বেড়েছে কিন্তু পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশ কর্মকর্তাদের আরো সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন।

আরো পড়ুন:

সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি রাতে খুলনা সদর থানাধীন শের এ বাংলা রোডস্থ হাজী বাড়ির মোড়ে ৭-৮টি মোটরসাইকেল যোগে ১০-১২ জন এসে ফার্নিচার ব্যবসায়ী রকিরকে (৩২) অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন রকিকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

নগরীর টুটপাড়া এলাকায় গত ২৯ নভেম্বর রাতে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক আমিন মোল্লাকে গুরুতর জখম করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নগরীর আলোচিত কিশোর গ্যাং লিডার আশিক বাহিনীর প্রধান আশিক, তার ভাই সজীবসহ ৯ জনের নামে মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

নিহতের ভাতিজা ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সালাউদ্দিন মোল্লা বুলবুল বলেন, ‘‘শত শত মানুষের সামনে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ত্রাস সৃষ্টি করে কুপিয়ে চলে গেল, মামলা হলো, অথচ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারল না।’’ 

গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সবজি বিক্রেতা নাঈম সানা গুলিবিদ্ধ হন। ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে নগরীর নিরালা এলাকায় ১০-১৫টি মোটরসাইকেলে এসে একদল সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে পথচারী ইউনুস শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এরপর সন্ত্রাসীরা চাঁনমারি এলাকায় গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এছাড়া ওই এলাকার আব্দুল আহাদ হাওলাদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে।

এভাবে গত তিন মাসে জেলা ও নগরীতে আটটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসীদের মহড়ার ঘটনা ঘটেছে ১০-১১টি।

নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীতে আগের মতো পুলিশের টহল ও অভিযান দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া কারাগারে থাকা বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরেছে। তিন-চারটি কিশোর গ্যাং সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর জিন্নাহপাড়া, মোল্পাপাড়া, লবণচরা ও শিপইয়ার্ড এলাকায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। মাদক বেচাকেনাও বেড়েছে। এছাড়া আগে বড় কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশের যে তৎপরতা বা অভিযান থাকত, তাও ঝিমিয়ে পড়েছে।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীরা সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। তাদের মধ্যে এখন আগের মতো ভয় নেই। এর ফলে অস্ত্রের মহড়া ও হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে।’’

মহানগর বিএনপি গত ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পুলিশ কাজে ফিরলেও তাদের আচরণ ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে নগরীতে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে।

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, ‘‘নগরীতে পুলিশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বিএনপির একজন নেতাকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পুলিশের আরও সক্রিয় হওয়া দরকার।’’

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু জানান, মূলত মাদক বেচাকেনা-সংক্রান্ত বিরোধ এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে এটা ঠিক কিন্তু পুলিশের তৎপরতা মোটেও ঝিমিয়ে পড়েনি। নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। 

তিনি জানান, ইতোমধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর আজিম ও তার সহযোগী রিয়াজুলকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্রধারীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা চলছে। টহল কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। 
 

ঢাকা/নুরুজ্জামান/বকুল

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়