ফুলকপির দামে ধস, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক?
এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম
শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে আসা ফুলকপি
“আগুর (আগাম) জাতের ফুলকপি সগলি লিবার চাচ্চিলো। সেইজন্যে তখন ফুলকপি বেঁচা লাব করছি। তখন বেঁচচি প্রত্যেক মুণ কপি বাইশশ’ টেকা থেকে চব্বিশশ’ টেকা। কিন্তু এখুন কেউ লিচ্চে না। দুইশ’ টেকা মুণ তাও লিবার চাচ্ছে না। আগুর চাষ করে লাব পাছি, কিন্তু নমলাত (দেরিতে) লাব পাচ্চিনা। হাটেত লিয়া আসমু সেই ভ্যান ভাড়াও তুলবার পারিচ্চি না।”
বলছিলেন বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে আসা ফুলকপি চাষি আব্দুল মোত্তালিব। তিনি বগুড়া শিবগঞ্জ উপজেলার তেঘর নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
এই চাষি জানিয়েছেন, তিনি এবার মোট ৫ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন। এর মধ্যে আগাম জাতের ফুলকপি চাষ করেছিলেন তিন বিঘা জমিতে। ওই ফসল উঠিয়ে বিক্রির পর আবারও দুই বিঘা জমিতে তিনি ফুল কপি চাষ করেন। আগাম জাতের ফুলকপি চাষের সময় তার খরচ পড়েছে প্রতি বিঘা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এরপরের ধাপে এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা কম। এক বিঘা জমি থেকে ৯০ থেকে ১০০ মণ ফলন উঠিয়েছেন তিনি। আগাম চাষ করা এক বিঘা জমির ফুলকপি তিনি ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। কিন্তু বর্তমান বাজারে এক বিঘা জমির ফুলকপি ৪ হাজার টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে না।
শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে ফুলকপি বিক্রি
গত দুই সপ্তাহ ধরে উত্তরবঙ্গের সবজির অন্যতম পাইকারি বাজার মহাস্থান হাটে ফুলকপির দামে এমন ধস নেমেছে। গত ৪ দিন আগেও হাটে ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ২ টাকা কেজিতে। বাধাকপির অবস্থাও প্রায় একই রকম। কপির দামে এমন ধসের কারণ হিসেবে বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, আমন মৌসুমের শুরুতে এবার বৃষ্টিপাত হওয়ায় প্রায় সব কৃষক শীতকালীন সবজি এক সাথে চাষাবাদ শুরু করেছেন। যে কারণে ফুলকপিসহ সব সবজি বাজারে এক সাথে এসেছে। আর এ কারণে কারণে ফুলকপির দামের অবস্থা এমন।
মহাস্থান হাটে আসা আরেক ফুলকপি চাষি খাজা সাবাবুদ্দিন জানান, তিনি ৬ মণ কপি হাটে নিয়ে আসছেন বিক্রি করার জন্য। হাটে আসার পর তিনি জানতে পেরেছেন তিনি যে কপি নিয়ে এসেছেন সেটি ২০০ টাকা মণ বিক্রি করতে পারবেন।
জমিতে যে ফুলকপি এখনও আছে সেগুলো কি বিক্রি হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিক্রি করলে তো করাই যায়, কিন্তু হামি কিছু জমির কপি ক্যাটা ফ্যালা দিয়ে আচ্চি। কারণ, হাটেত লিয়া আসলে দাম পাওয়া যায় ৫০ টেকা মুণ, ৮০ টেকা মুণ। গাড়ী ভাড়াই ৫০০ টেকা চলে যায়। জমিত থেকা হাটেত লিয়া আসলে তো আরও লস হচ্চে। হামি মুট দ্যাড় বিঘা জমিত কপি লাগাছিনু। এরমধ্যে ১০ কাঠা জমির কপি আগে বিক্রি করছি। সব মিলে হামার এবার লসই হচ্ছে। কারণ হামি কপি নমলা চাষ বেশি করছি।”
কপি চাষ করার পর কত দিনে ফলন তোলা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগুর কপি ৬৫ দিন আর নমলা চাষ করার কপি ৬৫ থেকে ৭৫ দিনও লাগে।”
শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে আসা ফুলকপি চাষি
তাজেল নামের ফুলকপি চাষি বলেন, “গত দুইদিন হলো ফুলকপির দাম উঠতেছে। আজকের বাজারে প্রতি কেজি ফুল কপি ৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ২ দিন আগে যেটা বিক্রি হয়েছে ২ টাকা-৩ টাকা কেজি। তখন গাড়ী ভাড়াই হয়নি। এখনও গাড়ী ভাড়া তুলতেই হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা। আগুর এবং নমলা এই দুই সময়ের মধ্যে যারা যারা শুধু আগুর করেছে তারা খুব ভালো লাভ করেছে। যারা দুইবার করেছে দাম পড়ে যাওয়ায় দেখা যাচ্ছে তাদের কেউ সমান সমান আবার কেউ অল্প পরিমাণ লাভ করতে পেরেছেন। কিন্তু যারা শুধুমাত্র নমলা চাষ করেছেন তারা এরকম দামের কারণে লোকসান ছাড়া লাভের মুখ দেখতে পারবে না।”
গাবতলীর কাগইল ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামের কৃষক মো. রাব্বী ইসলাম জানান, তাদের গ্রামে আগুর ফুলকপি চাষ হয় না। নমলাই করতে হয়। তিনি ২ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন। দুই বিঘা জমি থেকে তিনি ৮ হাজার টাকার ফুলকপিও বিক্রি করতে পারেননি। তিনি ঋণ করেছিলেন ৬০ হাজার টাকা। সেই টাকা তিনি কি দিয়ে শোধ করবেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
চন্ডিহারা গ্রামের কৃষক আলী আজম বলেন, “প্রতি বছরই নমলা চাষ করা ফুলকপির দাম আগুরের চেয়ে কম হয়। তাই বলে এত কম হয়নি। গত বছর ৭০০-৮০০ টাকা মণ ছিলো। উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে এরকম দাম কমে গেছে এটা অনেকে বলছে। অথচ গত বছরও কিন্তু উৎপাদন বেশিই হয়েছিলো। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি গত বছর ফুলকুপি মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে। এবার নাকি সেটা বন্ধ। এরকারণে নাকি এই অবস্থা। আমরা সরকারের কাছে দাবী করছি কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ফুলকপি, বাধাকপি রপ্তানি করা হয়। তা না হলে তো কৃষক মারা যাবে। দেশের সবাই তো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। অনেকে সচিবালয়ে চাকরি করেন তারও তো গ্রামের বাড়িতে জমি রয়েছে। সেখানে ফসল ফলানো হয়। তারাও তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকের দিকে কেউই তো তাকায় না।”
বাধা কপি চাষি আব্দুর রহিম জানান, তিনি তিন বিঘা জমিতে বাধা কপি লাগিয়েছিলেন। তার এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। মাল বিক্রির জন্য গাড়ী ভাড়া গুনতে গিয়ে টাকাই থাকছে না। মৌসুমের শুরুতে ২০ টাকা পিস বিক্রি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন ৮ টাকা করে বিক্রি করছেন তিনি। অথচ উৎপাদন খরচই ৮ টাকা। এভাবে তারা লোকসানে পড়ে যাচ্ছেন। ফলে সংসারে অভাব দেখা দিচ্ছে।
একই কথা জানিয়েছেন আরেক বাধা কপি চাষি শাহাদত হোসেন।
আবু বক্কর নামের এক ব্যাপারী জানান, তিনি সিলেটের মোকামে সবজি পাঠান। আজকে তাকে মোকাম থেকে ফুলকপির প্রতি মণের জন্য রেট দেওয়া হয়েছে ১০০ টাকা। এই টাকার বেশি দিয়ে কিনতে নিষেধ করা হয়েছে। যে কারণে তিনি এখনও কেনেননি। কারণ আজকের হাটে ফুলকপির দর ১৫০ থেকে ২২০ টাকা মণ।
তিনি বলেন, “ফুলকপি যে দামেই কেনা হোক না, যদি মাগনাও নেওয়া হয় এরপরেও প্রতি কেজিতে ৮-১০ টাকা করে খরচ যাবে। লেবার, হাট খরচ, গাড়ী ভাড়া, আড়ৎদারের কমিশন সব মিলিয়ে ৮-১০ টাকা পড়ে যায়। তাহলে আমরা যদি ২ টাকা কেজি কপি কিনি সেটা সিলেট পৌছাতেই ১২ টাকা কেজিতে পড়ে যাচ্ছে।”
মো. আব্দুস সালাম নামের এক আড়ৎদার বলেন, “আমরা প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দুইশ’ মণ ফুলকপি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ মোকামে পাঠাই। গাড়ী হিসেব করলে কোন দিন একগাড়ী আবার কোনো দিন দুই গাড়ী ফুলকপি পাঠানো হয়। আজকে আমরা ২০০ টাকা মণ কিনছি। এগুলোর ক্যারিং খরচ তিনগুণ দাম পড়ে যায়। সেখানে আমরা খুব অল্প লাভ রেখে ছেড়ে দিই। ওখানে আমরা এই কপি পিস হিসেবে বিক্রি করি। কোনটা ১০ টাকা। কোনটা ১২ টাকা। প্রতি পিসে গাড়ী ভাড়া, বস্তা, লেবার খরচসহ আনুষাঙ্গিক মিলে ৮ টাকা ১০ টাকা পড়ে যায়।”
মহাস্থান হাট এর ইজারাদারের অংশীদার শাহ আলম বলেন, “এখন প্রায় সব ধরণের সবজির দামই কম। ফুলকপি এবং বাধা কপির দামটা অস্বাভাবিক কম। উৎপাদন বেশি তাই এরকম বেশি হয়েছে। অন্য সবজিরও সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কম। বর্তমানে প্রতিদিন হাট থেকে ৩০ থেকে ৩৫ ট্রাক সবজি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। এছাড়া লোকালই ভ্যান, ভটভটিতে করেও আশপাশের জেলা এবং বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এত প্রতিদিন হাটে প্রতিদিন লেনদনের পরিমাণ দেড় থেকে ২ কোটি টাকার মতো। অন্য সময়েও এরকমই লেনদেন হয়, ওই সময় দাম বেশি কিন্তু পরিমাণে কম পণ্য যায়।”
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, “এবার আমন মৌসুমে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে শীতকালীন সবজির চাষাবাদ পিছিয়ে যায়। এই কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বরে বেশি দামে সবজি খেতে হয়েছে। এখন বাজারে সব সবজি একসাথে পাশপাপাশি উৎপাদনও বেশি হয়েছে। ফলে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় দাম কমেছে। চাষিরা যেনো কোনোভাবেই ক্ষতির মুখে না পড়ে সে বিষয়ে কৃষি বিভাগ সচেতন রয়েছে।”
ঢাকা/টিপু