জামাই–শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতা
রফিক সরকার, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) || রাইজিংবিডি.কম
বিনিরাইলে মাছের মেলায় মাছ দেখাচ্ছেন বিক্রেতারা।
গাজীপুরের কালীগঞ্জের বিনিরাইল গ্রামের ফসলের জমিতে প্রতি বছরের মতো এবারো বসেছে আড়াইশ বছরের পুরনো মাছের মেলা। এটি মূলত মাছের মেলা হলেও সবাই একে জামাই মেলা বলেই জানে। বিনিরাইল ও আশপাশের গ্রামের জামাইরা এ মেলার মূল ক্রেতা। জামাইরা যেমন বড় মাছ কিনে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য মেলায় আসেন, তেমনি শ্বশুররাও জামাইকে মেহমানদারী করার জন্য বড় মাছ কিনতে আসেন। মেলা যেন জামাই–শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতার মাঠ।
বিনিরাইল গ্রামে প্রতিবছর অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। মেলায় সকাল থেকেই বসেছে সারি সারি মাছের দোকান। সামুদ্রিক বড় মাছের পাশাপাশি এখানে দেশীয় প্রজাতির নানা মাছের সমাহার। মাছের মেলায় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গি ও সুরে সুরে হাঁক ডাক করছেন দোকানিরা। বড় মাছ মাথার ওপরে তুলে জানান দিচ্ছেন মেলার বড় মাছটি তিনি এনেছেন। দোকানিদের এমন চটকদারিতে ক্রেতারাও ঝুঁকছেন স্টলগুলোতে। মেলায় ৩ শতাধিক মাছের স্টল ছাড়াও রয়েছে আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি, নিমকি-মোরালি, হাওয়াই মিঠাই, বস্ত্র, হস্ত ও কুটির শিল্পের নানা পণ্যেরও বাহার।
কথিত আছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনাকে ঘিরে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে ১৮শতকে মেলাটির প্রচলন হয়। মূলত মাছ মেলা হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়। প্রতি বছর মেলাকে কেন্দ্র করে বিনিরাইল ও আশপাশের কয়েক গ্রামের শ্বশুররা তাদের মেয়ের জামাইকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানায়। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। জামাইরা মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যায়। সেই থেকেই এ মেলা জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়।
কথা হয় মেলায় ঘুরতে আসা কয়েকজন দর্শনার্থীর সাথে। তারা জানান, মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাইকে দাওয়াত করে আনা এই এলাকার মানুষের রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এই মেলায় দল বেঁধে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তারা ঘুরতে আসেন।
এ সময় কেউ কেউ জানান, তারা একেবারেই নতুন। এ মেলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি ভাইরাল, তাই দেখতে এসেছেন। মেলাকে ঘিরে বিনিরাইলের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ।
মেলার মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি বছরই এই মেলায় তারা আসেন। অন্য বছর বেচাকেনা ভালো থাকলেও এবারের বেচাকেনা খুবই মন্দা ভাব যাচ্ছে। তারা সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ বিক্রি করেন। মেলায় কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভিড় বেশী। তবে বেচা-কেনা যাই হউক স্থানীয় মানুষের সাথে সম্পর্কের কারণে প্রতি বছরই আসেন তারা।
এ অঞ্চলের জামাইরা তাদের শ্বশুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে বেড়াতে এসে মাছ কিনে শ্বশুর বাড়ি যায়। আবার শ্বশুররাও বড় মাছ কিনে জামাইদের সমাদর করেন। ব্যবসার পাশাপাশি জামাই শ্বশুরের এই যুদ্ধ দেখতে বেশ ভালো লাগে বলেও জানান তারা।
কথা হয় মেলায় মাছ কিনতে আসা এলাকার কয়েকজন জামাই ক্রেতার সাথে। তারা জানান, তারা এ উপজেলায় বিয়ে করেছেন। প্রতিবছরই এ মেলা উপলক্ষে দাওয়াত পান তারা। এবারও শ্বশুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে বৌ নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আর বেড়াতে আসলেই মেলা থেকে বড় মাছ কিনে শ্বশুর বাড়িতে যান এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ মেলা যেনো তাদের জন্য মিলন মেলা।
আয়োজকরা জানান, শুরুতে মেলা অনুষ্ঠিত হতো ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। এটি এক সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মেলা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে আয়োজন করে আসা বিনিরাইলের মেলার বয়স আড়াইশ বছর ছাড়িয়েছে। তাই বেড়েছে মেলার পরিধিও। মেলাটি এখন স্থানীয়দের কাছে ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা গাজীপুর জেলার সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবেও স্বীকৃত।
কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আলাউদ্দিন বলেন, “অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তিতে প্রতি বছর বিনিরাইল গ্রামে এই মাছের মেলার আয়োজন হয়। সাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে মেলায় থানা পুলিশ ও আনসার সদস্যের টহল থাকে। এছাড়াও মেলায় কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য মেলা প্রাঙ্গণে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।”
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, “বিনিরাইলের মাছের মেলাটি স্থানীয় একটি ঐতিহ্য। বহু বছরের পুরনো এই মেলাকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে রয়েছে নানা ধরণের কথা। তবে ইতিহাস ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে গ্রাম-গঞ্জে এ ধরণের আয়োজন সত্যি আমাদের চিরায়ত বাংলার রূপই ফুটে উঠে।”
ঢাকা/ইমন