ফসলি জমি দখল করে ‘ডেরা রিসোর্ট’ নির্মাণ, বিপাকে কৃষক
জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
মানিকগঞ্জের ঘিওরে বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পূরান গ্রামে অবস্থিত ‘ডেরা রিসোর্ট’
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পূরান গ্রামের কৃষক রেজ্জাক মিয়া। ৩৯ শতাংশ জমি চাষাবাদ করে ভালোই চলছিল তার দিনকাল। এক যুগ আগে তার এসব জমির উপর নজর পড়ে ‘ডেরা রিসোর্ট’ কর্তৃপক্ষের। কোনো দলিল দস্তাবেজ ছাড়াই জোর করে রেজ্জাকের কাছ থেকে ফসলি জমি দখলে নেয় ডেরা রিসোর্ট। পরে ওই জমির বিনিময়ে একযুগেও কোনো টাকা পাননি কৃষক রেজ্জাক মিয়া। একদিকে জমি হাতছাড়া, অন্যদিকে জমির বিনিময়ে টাকা না পাওয়ায় চরম হতাশ তিনি। জমি বা টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বরে ঘুরেও কোনো সুরাহা করতে পারেননি।
রেজ্জাকের মতো এমন অসংখ্য কৃষকের জমি দখল করে ৩৩ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ডেরা রিসোর্ট’। প্রতিষ্ঠানটির এমন অনিয়মের প্রতিবাদ করায় কৃষকরা ফেঁসেছেন মামলার জালে। কোথাও কোনো সমাধান না পাওয়ায় সম্প্রতি কৃষকরা তাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমেছেন। কৃষকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ডেরা রিসোর্টের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে জেলা প্রসাশকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন আলেম ওলামা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা। ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, দ্রুত কৃষকদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করবেন তারা।
অনুসন্ধান বলছে, শুধু কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে জমি নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি প্রতিষ্ঠানটি। নানা অপকৌশলে সরকারি খাস জমিও রিসোর্টের নামে করে নিয়েছেন তারা। ওই সময় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা বিষয়টি জানলেও বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে কেউ উদ্যোগ নেননি।
কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, “যেখানে ডেরা রিসোর্ট ওইখানে আমার ১৩ শতক জমিতে ১০৩টা ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল। যার একটাও আমাকে কাটতে দেয় নাই। গাছের তখনকার বাজার মূল্যই ছিল ৬-৭ লাখ টাকা। জমি এবং গাছের কোনো টাকাই আমি পাইনি। তাগো (দখলকারী এশিউর গ্রুপ) কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি অনেক, কেউ দেখা করে নাই। উল্টা আমার নামে মামলা দিছিল। মামলায় ১২ বছর হাজিরা দিছি। মামলায় জরাইয়া আমি এহন নিঃস্ব।”
বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পূরান গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, “ডেরা রিসোর্টের থাবায় কবরস্থানও বাদ পড়ে নাই। জোর কইরা কবরস্থানে রিসোর্ট বানাইছে। ওই সময় নেতাগো ডরে কেউ কতা কইবার পারে নাই। কবরস্থানের ল্যাইগা অন্য জায়গা দিছে। তয় কতা আচিলো যাগো বাপ-দাদার কবর আছে তারা রিসোর্টের কার্ড পাইবো। ওই কার্ড নিয়া রিসোর্টে ডুইকা কবর জিয়ারত করবার পারবো। কিন্তু কবরস্থান দখল নিবার পরে কার্ডও দেই নাই, কেউ কবর জিয়ারতও করবার পারে নাই। কবরস্থানের জমিতে এহন হরিণ পালে। এর চেয়ে কষ্টের আর কি অইবার পারে!”
অপর কৃষক সত্তার মিয়া বলেন, “জমির মূল্য পরিশোধ না করে দখল নিয়ে রিসোর্ট নির্মাণ করায় কৃষকদের সাথে ‘ডেরা’ কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ শুরু হয়। তাদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাদের সখ্যতা থাকায় এবং মামলার ভয়ে ওই সময় অনেকে আর তাদের বাধা দিতে পারেনি। এখন কৃষকরা একজোট হয়ে তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। শুধু জমির টাকা ফেরত নয়, কৃষকদের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে তার প্রতিকারও চাই আমরা।”
এলাকাবাসীর ভাষ্য, ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির সূচনা লগ্ম থেকেই এলাকার কৃষকদের সাথে মিথ্যাচার করেছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো কৃষি জমিতে আধুনিক এগ্রো ফার্ম নির্মাণ করা হবে। সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি জমি কেনা শুরু করে। ওই জমিগুলোতে কয়েক বছর এগ্রো ফার্মকেন্দ্রিক কার্যক্রম থাকলেও পরে সেটি রিসোর্টে পরিণত হয়। সবার সামনে এগ্রোর বিষয়টি নিয়ে এলেও তাদের মতলব ছিলো ভিন্ন। ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে তারা এগ্রোকে দৃশ্যমান করে ‘ডেরা রিসোর্ট’ করেছেন। ফলে প্রথমদিকে স্থানীয়রা এগ্রোর বিষয়গুলোকে এলাকার উন্নয়ন চিন্তা করে তেমন বাধা দেননি। পরবর্তীতে জমি দখল শুরু করলে বাধা দিলেও প্রভাবশালীদের তোপের মুখে আর মামলা-হামলার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের সহযোগিতায় বালিয়াখোড়া গ্রামে অত্যাধুনিক এগ্রো ফার্ম করতে কৃষি জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই সকল জমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে ডেইরি ফার্ম নির্মাণ করা হয়।
পরে ২০২২ সালে ওই ডেইরি ফার্ম এলাকায় এশিউর গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টার নামে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়। ডেইরি ফার্মের সাইনবোর্ড থাকা অবস্থায় চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে শুরু হয় রিসোর্ট নির্মাণের কাজ।
সেসময় বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়ে কাজ বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এলাকাবাসীদের দমাতে তাদেরকে মামলায় ফাঁসানো হয়। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের আশকারায় রিসোর্টৈর কাজ পুরোদমে চালু হয়। দুই বছর কাজ শেষে ২০২২ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় পাঁচ তারকা মানের এই অবকাশযাপন কেন্দ্রটির।
এই রিসোর্টে হেরিটেজ কটেজে আছে ৩টি রুম, হাব কটেজে ৪টি, সুপেরিয়র ফ্যামিলি কটেজে ২টি, প্রেসিডেন্সিয়াল কটেজে ৩টি, গল্ফ ভিউ ৫টি কটেজে মোট ১০টি রুম, ভিআইপি কটেজে ২টি, লেকসাইড ৭টি কটেজসহ মোট ১৪টি রুম রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মিটিং এন্ড কনফারেন্সের জন্য ৪৫শ’ স্কয়ার ফিটের শোভা ব্যাঙকুয়েট হল, সিনেপ্লেক্স, ট্রি হাউস, ওয়েভ পুল, গ্রিনহল, সুইমিংপুল, গলফ গ্রাউন্ড, জিমনেশিয়াম, এভি সিস্টেমসহ মিটিং রুম, ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৬টি হলরুম, কায়াকিং করার সুবিধা।
রিসোর্টটির বড় এডভেঞ্চার এখানকার স্পা সেন্টার। রিসোর্টটিতে ন্যূনতম ভাড়া শুরু হয় প্রতি রাতের জন্য ৮ হাজার টাকা। কক্ষের রকম বা সুযোগ-সুবিধা ভেদে ৫০ হাজার টাকা প্রতি রাতের ভাড়া এমন কক্ষও রয়েছে রিসোর্টটিতে। কনফারেন্স রুমের ভাড়া দৈনিক ২ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, “এটা একটা এগ্রো বেইজড রিসোর্ট। আমরা বাংলাদেশে এগ্রো রিসোর্টের জন্য উদাহরণ। আমাদের এখানে বিভিন্ন ধরনের কৃষি চাষাবাদ আছে। আমরা এখানে হাঁস, গরু, মাছ এবং বিভিন্ন অর্গানিক শাক-সবজী, কলা, লেবু, সরিষা, আলু চাষ করি। যেটা এখান থেকে আমাদের অতিথিরাও নিয়ে থাকেন আবার আমরা নিজেরাও ব্যবহার করি। আমাদের আগের যে এগ্রো লাইসেন্স সেটি রিসোর্ট লাইসেন্সে রূপান্তর করে এখন রিসোর্ট লাইসেন্স হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। কয়েকজন কৃষকের টাকা প্রক্রিয়াগত কারণে আংশিক পরিশোধ হয়নি। দ্রত তাদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হবে।”
গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে জমি দখলে নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি এই প্রতিষ্ঠানটিতে দুই বছর যাবত কর্মরত আছি। আমাদের হিস্ট্রিতে এমন কোনো ঘটনা নেই। এগুলো সব মিথ্যা বানোয়াট।”
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “ডেরা রিসোর্টের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
ঢাকা/এস