যমুনা রেলসেতুতে সময় বাঁচবে ৩০ মিনিট
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

যমুনা রেলসেতু অতিক্রম করছে একটি ট্রেন
বাংলাদেশের যোগাযোগ খাতে যুগান্তকারী প্রকল্প যমুনা রেলসেতু। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান শেষে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) এই সেতু উদ্বোধন হয়। প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু অতিক্রমে ট্রেনের সময় লাগছে সাড়ে ৩ মিনিট। ফলে সেতুর দুই প্রান্তের মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও আনন্দ বিরাজ করছে। তাদের দাবি, দুই প্রান্তের স্টেশনের পরে থাকা সিঙ্গেল লেন যেন দ্রুত ডাবল লেনে উন্নীত করা হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকী জানান, খড়স্রোতা যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দীর্ঘতম যমুনা রেলসেতু চালু হয়েছে। এর ফলে রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা হলো।”
তিনি আরো বলেন, “তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিটেই ট্রেনে করে সেতুটি অতিক্রম করা যাবে। এর আগে, যমুনা বহুমুখী সেতুর মাধ্যমে ট্রেনে নদী পার হতে সময় লাগতো ২৫ থেকে ৩৫ মিনিট। সব মিলিয়ে সময় বাঁচবে অন্তত ৩০ মিনিট। যমুনা রেলসেতুর সুবিধা ভোগ করবে উত্তরের ১৬ জেলার পাশাপাশি আশপাশের আরো কয়েকটি জেলার মানুষ।”
মঙ্গলবার ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশন প্রাঙ্গণে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনইচি ও জাইকার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক ইতো তেরুয়ুকি উপস্থিত ছিলেন। স্বাগত বক্তব্য দেন যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান। অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে সমাপনী বক্তব্য দেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন।
অতিথিরা অনুষ্ঠানের মঞ্চে টাম্বলার লিভার (রেলের লাইন পরিবর্তনের যন্ত্র) টেনে রেলসেতুর উদ্বোধন করেন। পরে অতিথিরা বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়ান।
যমুনা সেতু ক্যান্টমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র হামিম তালুকদার বলেন, “উদ্বোধনী ট্রেনে সেতুর সিরাজগঞ্জ প্রান্ত থেকে ঘুরে এসেছি। সেতুটি দুই লেনের হলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত সিঙ্গেল লেনের লাইন রয়েছে। এটি ডাবল লেনের হলে পুরোপুরি সুবিধা পাওয়া যাবে। কারণ এখনো রেল ক্রসিংয়ের জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করতে হয়।”
টাঙ্গাইল ব্যবসায়ী ঐক্যজোটের সভাপতি আবুল কালাম মোস্তফা লাবু বলেন, “রেলসেতু উদ্বোধনের আমরা আনন্দিত। মালবাহী ট্রেনগুলো যদি সেতুর পূর্ব প্রান্তের ইব্রাহিমাবাদ ও টাঙ্গাইল স্টেশনে থামে তাহলে টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী ও ভোক্তা যারা রয়েছেন, উভয়ে লাভবান হবেন। কারণ ট্রাকের চেয়ে ট্রেনে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হয়।”
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫০টি পিলার আর ৪৯টি স্প্যানের ওপর অত্যাধুনিক স্টিল প্রযুক্তির অবকাঠামোতে নির্মিত ডাবল লেনের সেতুটি দিয়ে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ট্রান্স এশিয়ান রেলপথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করবে বাংলাদেশ। দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হবে। আমদানি-রপ্তানি খরচ কমে যাওয়ার পাশাপাশি যমুনা সেতু ও মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে। উত্তরাঞ্চল থেকে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হবে। যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে। আগে যমুনা সেতু দিয়ে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করলেও নতুন সেতু দিয়ে ৮৮টি ট্রেন চলাচলের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ট্রেন চলাচলের আন্তঃসংযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, “মূল সেতু পার হতে ট্রেনে সময় লাগবে দুই-তিন মিনিট। সেতুর দুই পাড়ের স্টেশন সয়দাবাদ ও ইব্রাহিমাবাদের মধ্যে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এই অংশ পার হতে ৭ মিনিটের বেশি লাগবে না। নতুন সেতু দিয়ে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি যাতায়াতের সময়ও কমবে। নতুন সেতু চালুর ফলে পুরোনো যমুনা সড়কসেতুর রেলপথ দিয়ে আর ট্রেন চলাচল করছে না।”
১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর যমুনা বহুমুুখী সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ শুরু হয়। ২০০৬ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে থাকে। গতি কমের কারণে সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটে থাকে শিডিউল বিপর্যয়। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেলওয়ে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। পরে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা করা হয়। যার মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ দেশীয় অর্থয়ান এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর যমুনা নদীর ওপর নির্মিত যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে দেশের দীর্ঘতম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।
জাপানের আইএইচআই, এসএমসিসি, ওবায়শি করপোরেশন, জেএফই এবং টিওএ করপোরেশন এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তিনটি প্যাকেজে সেতুর নির্মাণকাজ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে আসার পর বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুটির নাম পরিবর্তন করে যমুনা সেতু নামকরণ করা হয়।
ঢাকা/কাওছার/মাসুদ