ঢাকা     সোমবার   ২৪ মার্চ ২০২৫ ||  চৈত্র ১১ ১৪৩১

ভয়াবহ শিল্পদূষণ, সুতাং নদীর পানি-মাছে মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২৯, ২২ মার্চ ২০২৫   আপডেট: ২০:৩৩, ২২ মার্চ ২০২৫
ভয়াবহ শিল্পদূষণ, সুতাং নদীর পানি-মাছে মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সুতাং নদীর পানি ও মাছের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করছেন।

হবিগঞ্জে ভয়াবহ শিল্পদূষণে সুতাং নদীর পানি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া নদীর পানির ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সুতাং নদীর পানি ও মাছের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করছেন। প্রায় এক দশক ধরে শিল্পদূষণের শিকার এই নদীর দূষণের মাত্রা নির্ধারণের জন্য গবেষকরা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে পানি, মাছ ও পলির নমুনা সংগ্রহ করছেন।

গবেষণা প্রকল্পের প্রধান এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. শাকির আহম্মেদ বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছি যে, পানি ও মাছের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। বর্তমানে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য আরও পরীক্ষা চলছে।”

গবেষক দলের সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক ইফতেখার আহমেদ ফাগুন বলেন, “পরীক্ষাগার বিশ্লেষণে ইতোমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, পানি ও মাছের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও, শিল্পদূষণের ফলে নদীর পানির ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে নদীর নিম্নপ্রবাহে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।”

প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা অত্যন্ত কম, যা স্বাদুপানির মাছের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক নিচে। এছাড়া, গবেষকরা অক্সিডেশন-রিডাকশন পোটেনশিয়াল-এর এমন একটি মান পেয়েছেন, যা নদীতে হ্রাসকারক অবস্থা নির্দেশ করে। নদীর পানির পরিবাহিতা এবং মোট দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের মাত্রাও স্বাদুপানির বাস্তুতন্ত্রের উপযুক্ত সীমার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি পাওয়া গেছে।

নমুনা সংগ্রহের সময় গবেষকরা দেখতে পান যে, নদীর নিম্নপ্রবাহে মাছের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বিশেষ করে শৈলজোড়া খালের সংযোগস্থলের আশপাশের এলাকাটি সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল, যেখানে শিল্পবর্জ্য নদীতে প্রবাহিত হয়। এই অঞ্চলে কোনো মাছ বা জলজ প্রাণি পাওয়া যায়নি।

খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য তোফাজ্জল সোহেল বলেন, “কৃষিজমি, প্রাকৃতিক গ্যাস ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতার জন্য এই অঞ্চলে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করেছে বৃহৎ ও মাঝারি কলকারখানার। কারখানাগুলো অপরিশোধিত বর্জ্য নিক্ষেপ করে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে আসছে। যত্রতত্র কৃষিজমি, খাল, ছড়াসহ সকল প্রকার জীবন জীবীকা দূষণের শিকার হয়েছে।” 

তিনি আরো বলেন, “কৃষিজমি ধ্বংস, ফসলের ক্ষতি, নিরাপদ পানির অভাবসহ ক্রমাগত দূষণের কারণে চরম পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে সুতাং পাড়ের মানুষের মাঝে।”

তিনি বলেন, “২০১৫ সালের শুরুতে কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থার নামে শৈলজুড়া নামক খালটি পুনঃখনন করে কয়েকটি কারখানার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে কোম্পানি-গুলোর অপরিশোধিত বর্জ্য সহজে খালের মাধ্যমে সুতাং নদীতে ছাড়া হচ্ছে। সুদূর মেঘনা পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে এই দূষণ।”

সম্প্রতি নদীর দূষণ এলাকার ১২টি স্থানে ৩০ বারের অধিক ঝাঁকি জাল ফেলে ৩টি ছোট পুঁটি মাছ, একটি ছোট টাকি মাছ ও একটি খলসে মাছ পাওয়া যায়। 

এলাকাবাসীর অভিযোগ- মাছ, ব্যাঙসহ নদীর পানিতে কোন জলজ প্রাণি নেই। শামুক, ঝিনুক পর্যন্ত মরে গেছে। নদীর দূষণ এলাকায় প্রাণের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে।

তোফাজ্জল সোহেল আরো বলেন, “দেশের সবথেকে ভয়াবহ দূষণের নদী হিসেবে সুতাং নদী পরিচিতি পেয়েছে। মাটি, পানি, বাতাসের ভয়াবহ দূষণের কারণে নদীপাড়ের জীবন জীবিকা চরম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও দুর্গন্ধের ভেতর দিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে গ্রামবাসী। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা পরিবেশ বিমুখ এই শিল্পায়ন উন্নয়ন নয়, বরং এই অঞ্চলে ধ্বংস ডেকে এনেছে। চলমান দূষণ প্রক্রিয়া দ্রুত বন্ধ না করলে পরিবেশ ও জনসাস্থ্য মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।”

ঢাকা/মামুন/এস


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়