ঢাকা     শনিবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩২

চড়ক মেলায় মেতে উঠেছিল নাটোরের শংকরভাগ 

নাটোর প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৪, ১৫ এপ্রিল ২০২৫  
চড়ক মেলায় মেতে উঠেছিল নাটোরের শংকরভাগ 

শংকরভাগ গ্রামের মেলায় চড়কে সন্ন্যাসী

নাটোর শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের শংকরভাগ গ্রামে চড়ক পূজা এবং চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে বসেছিল মেলা। দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ মেলা রূপ নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলায়।  

মঙ্গল ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি কামনায় শংকরভাগ গ্রামে প্রতিবছর আয়োজন হয়ে আসছে এ চড়ক মেলার। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি ঐতিহ্যবাহী লোকোৎসব। 

সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল থেকে শুরু হয় এ মেলা। মেলাকে ঘিরে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শংকরভাগ গ্রাম জুড়ে চলছে এ উৎসবের আমেজ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এসেছে এ মেলায়। মনের বাসনা পূর্ণ করতে পূজা অর্চনা ও বিভিন্ন রকম ফল, হাঁস-মুরগি ও ছাগল মানত করেন তারা।

দুপুর থেকেই শংকরভাগ গ্রামের স্কুল মাঠ মানুষের পদচারণায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। কে হিন্দু, কে মুসলমান এটাও যেন চেনা ছিল দায়। সবাই ছিল উৎসবে-আনন্দে মাতোয়ারা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় দু’শ বছর ধরে এ এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই চড়ক পূজা। এ চড়কের মিলনমেলা আজও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে চড়কের মেলায় একসময় স্থানীয় আদিবাসীদের নৃত্য দেখা গেলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না। 

মানুষের পিঠের সঙ্গে বড়শি বিঁধিয়ে ঘোরানোই এ মেলার ঐতিহ্য। তারা স্বেচ্ছায় এ কষ্টকর কাজটি তাদের ধর্মীয় বোধ থেকে করে যাচ্ছেন।

ওই গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বয়সের শহিদুল্লাহ শহিদ জানান, এ গ্রামে আদিবাসীদের বসবাস বেশি। কিন্তু প্রভাবশালীদের অত্যাচরে অনেক আদিবাসী গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগে ভারতে। এরপরও নানা প্রতিকূলতা মধ্য দিয়ে তারা বাঙালির কৃষ্টি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছরই এ সময়ে খুব ঘটা করেই চড়ক পূজা উপলক্ষে মেলার আয়োজন করে থাকে।

মেলাকে ঘিরে হাজার হাজার নানা ধর্মের মানুষের ঢল নামে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শংকরভাগের ১৪২ ঘর আদিবাসী ছাড়াও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সবাই মিলেই চৈত্র মাসের শেষ দিনে এক হয়ে মিশে যায় উৎসব উদযাপনে। মেলাকে কেন্দ্র করে পসরার দোকানে ছিল চিনি-গুঁড়ের জিলাপি, মুড়ি-মুড়কি, কদমা, চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া, মিষ্টি, হাওয়াই মিঠাই, মহিষের দুধের ঘোল ও পেঁয়াজুসহ আরও অনেক কিছু।

মেয়েদের জন্য ছিল কাঁচের চুড়ি, মালা, ফিতা, টিপ ও সিঁদুর।  গৃহিণীর জন্য ছিল লোহার তৈরি জিনিসপত্র দা, বটি, ঘটি, বাটি, খুন্তি ও কাঠের তৈরি নানা জিনিস।  আরও ছিল ভিউকার্ড, ঝিনুকের তৈরি শো-পিস-গহনা, শাঁখ-শাঁখা, পলা আরও কতো কী।

মেলায় আসা সিংড়ার কৃষ্ণা রাণী দাস জানান, তার ৫ বছরের শিশুর রোগ মুক্তির জন্য তিনি এ পূজায় এসেছেন। তিনি দু’টি মুরগি ও বাতাসা মানত করেছেন।

নাটোর শহরের বিনতি রানী, সবিতা মুখার্জি, মায়া পাল জানান, এ পূজায় মানত করলে নাকি মনের বাসনা পূর্ণ হয়। রোগ বালাই ভাল হয়, তাই তিনি তার স্বামীর রোগ মুক্তির জন্য এখানে এসেছেন। এটাই তাদের বিশ্বাস।

পাবনা জেলার রাখী সরকার জানান, বিয়ে হওয়া প্রায় ৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু তার কোনো সন্তান হয়নি। লোকমুখে শুনেছেন, এই চড়কে মানত করলে নাকি বাচ্চা হয়। তাই তিনি বাচ্চার আসায় মানত করতে এখানে এসেছেন।

মেলা প্রসঙ্গে ওই গ্রামের ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সমেন্দ্র নারায়ণ হোড় জানান, প্রায় দু’শ বছর ধরে এখানে চড়ক পূজা হচ্ছে। আগে নাকি আরও বড় করে আয়োজন হতো। তখন যারা চড়ক গাছে ঘুরতো তাদের আগের দিন রাতে মন্ত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। তারা আগুনের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতো, ধারালো অস্ত্র-শস্ত্রের ওপর খালি পায়ে দাঁড়াতো। কাটতো না, পুড়তোও না। কিন্তু এখন আর এতো নিয়ম পালন করা হয় না।

হরিপদ সাহা জানান, পুকুরে ডুবিয়ে রাখা চড়ক গাছ চৈত্র সংক্রান্তির সকালে তুলে আনা হয়। পরিষ্কার করে পূজা শেষে চড়কের জন্য প্রস্তুত করা হয়।  তিনটি বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে লাল কাপড়ে জড়িয়ে নেওয়া হয়। ৪০-৫০ ফুট উঁচু গাছের মাথায় যে চড়ক লাগানো হয়, পূজা শেষে দুধ ও জল দিয়ে স্নান করানো হয়। পরে সন্ন্যাসীদের পিঠে বান (এক ধরনের বড় বড়শি) ফোঁড়ানো হয়। তারা সারাদিন জল না খেয়ে উপবাস করেন। এরপর দুপুরের পর থেকে শুরু হয় মূল আয়োজন। একে একে সন্ন্যাসীদের নেওয়া হয় শিববাড়ি মন্দিরে, সেখানে মন্ত্র এবং ওষুধি গাছের সাহায্যে সন্ন্যাসীদের আচ্ছন্ন করা হয়। কোমরে বেঁধে দেওয়া হয় লালসালু, যার ভেতরে থাকে মন্ত্রপুত কড়ি এবং ওষুধি গাছ। ফলে কোনো রকম সমস্যায় পড়তে হয় না তাদের।  

পরে দড়ি বেঁধে চড়ক গাছের সঙ্গে ঘোরানো হয় সন্ন্যাসীদের। এ সময় মঙ্গল কামনায় সন্তানদের শূন্যে তুলে ধরেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরে ঘুরে সে সব শিশুদের মাথা স্পর্শ করেন। অনেক সময় কোলেও তুলে নেন, ছিটিয়ে দেন খাগরাই-বাতাসা। চড়ক পূজা শেষে সন্ন্যাসীরা খাবার স্পর্শ করেন।

শংকরভাগ চড়ক পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি হারান চন্দ্র গোস্বামী জানান, অন্যান্য বছর অন্তত ৫০/৬০ জনকে কালা বা বড়শি ফোঁড়ানো হতো। এ বছর ৩০ জনকে ফোড়ানো হয়েছে। মেলা পরিচালনার জন্য ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি রয়েছে। দিনব্যাপী মেলায় বড়শি ফোঁড়ানো ও পূজা অর্চনা করা হয়। এ উপলক্ষে গান বাজনা করে উৎসব চলে।

তিনি আরো জানান, চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। চড়ক পূজার উৎসব চলে বৈশাখের প্রথম দু’তিন দিনব্যাপী। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এ পূজা প্রথম শুরু করেন।  

নাটোর সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. আখতারজাহান সাথী জানান, এ মেলায় যাতে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিয়োজিত রাখা হয়। মেলা উদযাপন কমিটিসহ স্থানীয় জনগণ সুন্দরভাবে মেলার আয়োজন করেছেন। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।

ঢাকা/আরিফুল/টিপু 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়