ফজলুল হক সৈকত-এর গল্প
একটি হত্যা-পরিকল্পনা এবং পুনর্জন্ম
ফজলুল হক সৈকত || রাইজিংবিডি.কম
রাইজিংবিডি২৪.কম:
ঘর থেকে বেরিয়েই কয়টি পিঁপড়ার হত্যাকারী হিশেবে নিজেকে আবিষ্কার করে শামীম সিকু। একটু বিচলিত হয় সে। অবশ্য মুহূর্তকতেক পরে স্বাভাবিক বোধও করতে থাকে। কেননা, পিঁপড়ার মৃত্যুতে ভড়কে যাবার মতো নির্বোধ হওয়া অন্তত তার পক্ষে মানানসই নয়, এমনটি ভেবে নেয়। একটু বসে যাবে কি-না ভাবে সে। তা-ও মুহূর্তমাত্র। তারপর নামতে থাকে। সিঁড়ি বেয়ে। রাস্তায় নেমে দ্রুত রিক্সায় উঠে পড়ে। আনমনে ঘড়িতে চোখ রাখে বারবার। আজও বোধ হয় সময়মতো অফিসে পৌঁছুতে পারবে না। আজকাল তার এ রকমটি ঘটছে। দেরি হচ্ছে। শুধু অফিসের বেলায়ই নয়- মিটিং, বাজার, আড্ডা, দরকারি ফোন, বাড়িফেরা সবকিছুই অস্বাভাবিক-অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে চলেছে। সিকু এর কোনো কিনারা পায়নি কিংবা বলা যায় পাবার চেষ্টাও করেনি।
মিনিট কুড়ি দেরিতে অফিসে নিজের কামরায় ঢোকে সিকু। তারপর ফোনবুকের পাতা উল্টিয়ে জরুরি কিছু ফোন সেরে নয়। একটা অজরুরি ফোন এখনই করবে কি-না তা-ও ভাবে একবার। পরে- দুপুরের দিকে করবে সিদ্ধান্ত করে সে ভাবনায় ইতি টানে। পাশের টেবিলে, সামনে কাচের দেয়ালের ওপাশে যে যার কাজে ব্যস্ত আছে হয়তো। সিকু সেদিকে দেখে না [আনমনে তাকায় কি-না তা-ও তার অজানা]। বসের সুন্দরী লম্বাটে পিএ পাশ ঘেঁষে হেঁটে যায়। সে সিকুকে দেখে না। সিকু ঘাড় কাত করে ওর যাবার ভঙ্গিটি মুখস্থ করতে থাকে। আগে- প্রথম থেকেই মেয়েটিকে তার ভালো লাগতো। এই ভালোলাগার জ্বরে ভুগেছে সে একটানা অনেকদিন। তাপরপর তা অ্যাম্বুলেন্সের চিৎকারের মতো বাতাসের অন্ধকারে মিশে গেছে। সিকুর প্রতি ওপক্ষের টান ছিল কি-না, তা হলফ করে বলা যায় না। দু-একবার পজেটিভ পজিশান দেখেছে সিকু। তবে সত্যি- এখন মেয়েটিকে ভালোলাগা-না-লাগার ব্যাপারে তার কোনো খেয়াল নেই। পর্যবেক্ষণ করলে হয়তো মনের তাপমাত্রা কমতির দিকেই দেখা যাবে। মেয়েটি হাঁটতে থাকে আগের চেয়ে আরো আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। আর সিকু প্রায় অজান্তেই কবিতার কয়টি চরণে মন বুলাতে থাকে :
চালকুমড়ার ছাঁচে আজ ভুঁইকুমড়ার বাস
ছাদকুমড়ার স্বকীয়তা মানুষের আশ!
... ... ...
বৃত্তাবদ্ধ মানুষ-মানবতা-হন্তারক
নিত্য প্রতারিত মানুষ; মানুষই প্রতারক।
এবার নিজেকে বন্দী ভাবতে থাকে শামীম সিকু। পরাধীন ভাবতে থাকে। আর ব্যর্থ হতে থাকে আপন ভুবন-পরিসর-প্রসারণ-ব্যথা নিবারণের চেষ্টায়। অফিসের কাগজে মন দিতে গিয়েও পারে না সিকু। ব্যক্তিগত একটা কাগজে দৃষ্টি স্থির হয় তার। ঠিকানা দেখতে পায়, একটা ফোন নম্বরও চোখে পড়ে। কী ভেবে জরাগ্রস্ত আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় রিসিভারের পেটে-আঁটা নম্বরগুলো চাপতে থাকে।
- হ্যালো, এটা কি মাল্টি প্রোডাকশন কোম্পানি? মিস নাবিতা কি আছেন?
- নাবিতা কাপালি?
-উনি এখন সিটে নেই?
কোনোরকম সৌজন্য ছাড়াই ফোন রাখে সিকু। টুকিটাকি কিছু কাজ সেরে নেয় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে। লাঞ্চে আরেকবার কাপালিককে ট্রাই করবে ভেবে রাখলেও তা আর করা হয় না।
ঠিক দেড়টায় সিকু বেরোয় লাঞ্চে। ‘নীরবে’ দুপুরের খাবার সেরে নেয় সে প্রায় প্রতিদিন। আজও হাঁটতে থাকে সেদিকেই। অফিসে না ফিরে, পালিয়ে, অন্য কোথাও যাবে কি-না ভাবে একবার। তারপর বিরক্ত হয়ে, নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যে, খামখেয়ালির জন্যে, মাথায় থাপ্পড়ও মারে দু-তিনবার। চারদিকে দেখে কেউ দেখেছে কি-না। নিশ্চিত হয়ে এগুতে থাকে সিকু। হঠাৎ সে আবিষ্কার করে, তারই আগে আগে হেঁটেচলা এক কিশোরীকে। সত্যিই কিশোরী কি-না [যুবতী হয়তো] সে বিষয়ে সিকু নিশ্চিত নয়। তবে ছোটজামা [সম্ভবত শর্টস্কার্ট] দেখে এরকমই অনুমান করে। সিকুর চোখ স্থির হয় হাঁটুর পেছনভাগের স্পষ্টভাঁজ আর ওপরের ইঞ্চিচারেক মাংশল ক্যানভাসে। তারপর দৃষ্টি একবার নিচের দিকে- পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে দ্রুত ওপরের ভাঁজ পেরিয়ে টিলার শীর্ষদেশে অবগাহন করতে থাকে। টিলার টানটান বাঁধনমন্ত্র শামীমকে টেনে নিতে থাকে ‘নীরব’ অতিক্রান্ত গভীর কোনো নীরবতার দিকে। সরব চৌরাস্তা ছেড়ে কখন যে গলিপথে ঢুকেছে, তা এতক্ষণ টের পায়নি শামীম সিকু। বাঁকে অপেক্ষমাণ এক ছেলেবন্ধুর রিক্সায় মেয়েটি যখন উঠে বসে, তখন সিকু নিজেকে আবিষ্কার করে বস্তুগত এবং ভাবগত অবস্থানের মধ্যবর্তী এক বক্ররেখায়।
একটু এগিয়ে মোবাইল চা-স্টল থেকে এক কাপ চা নেয় সিকু। একটা ট্রিপল ফাইভ ঠোঁটে চেপে স্টলটির একপাশে দাঁড়ায়। ঠায়। পাঁচটি ফাইভ ফাইভ শেষ করে সে। কী ভেবে এবার অবাক হয় সিকু। জীবনে পাঁচের অনতিক্রম্য এক প্যাঁচের উপস্থিতি টের পায় সে। ধীরে ধীরে মনে করতে থাকে- পাঁচ বছর বয়সে মা হারানো, উচ্চমাধ্যমিকে পাঁচ নম্বরের জন্য মেধা তালিকায় স্থান না পাওয়া, ইউনিভার্সিটিতে পাঁচ বছরের সেশন-জ্যামে পড়া, কোয়ালিফাই করেও পাঁচদিন পর চিঠি হাতে পাওয়ায় প্রথম চাকুরিতে যোগ দিতে না পারা, গত পাঁচ তারিখে প্রথমবারের মতো একটি জরুরি হত্যা কাণ্ডের পরিকল্পনা বানচাল হওয়া, এমনকি একটু আগে দেখা কিশোরী [কিংবা তরুণী] কে বয়সে নিজের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট মনে হওয়া। পাঁচের প্যাঁচে বিভ্রান্ত শামীম সিকু আরেক কাপ চা খাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে পাশ ফিরে স্টলটিকে দেখতে পায় না। দেখতে পায় তাকে পাহারারত [অবস্থাদৃষ্টে তা-ই মনে হয়] পাঁচজন অস্বাভাবিক তরুণকে। এবার রীতিমতো ভয় পেতে থাকে সে। এদের প্রত্যেকেরই টাকমাথা [পরিকল্পিত কি?], পরনে জিন্সের লেসওয়ালা হাফ প্যান্ট, তারকাছবিখচিত গেঞ্জি আর হাতে বড় সাইজের মোবাইল ফোন। এদের একজন সিগারেটে সুখটান দিয়ে সাবধানে পা-চেপে আগুন নিভিয়ে শামীমের দিকে তাকায়। কী বৃত্তান্ত জানতে চায়। পরিচয়ও জিজ্ঞাসা করে; নরম গলায়। গলা নরম শোনালেও চোখে তার আগুনের উত্তাপ। অন্য চারজন ইতঃস্তত বিচরণরত- শামীম সিকুর অনতিদূরে। ভয়জ্বরে কাঁপতে থাকে সিকু। কাঁপতে থাকে ...
সিকু নিজেকে আবিষ্কার করে, তৃতীয়বারের মতো, ময়লাজমা একটা ড্রেনে হাতবাঁধা অবস্থায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে উঠে দাঁড়ায় বটে, কিন্তু হাটুতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করায় এগোতে পারে না। অফিসে কিংবা বাসায় ফোন করা প্রয়োজন ঠিক করে পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল ফোনটির অনস্তিত্ব টের পায় সে। তারপর কী ভেবে রিক্সায় চাপে। রমনায় লেকের পাশে বসে। তখনও সন্ধ্যা হয়নি। চারদিকে লোকজনের আনাগোনাও আছে। যারা পাশ ঘেঁষে চলেছে কিংবা একটু দূরে বসে আছে, এদের কাউকে কাউকে ভালো ঠেকে না তার। ধান্দাবাজ-ধান্দাবাজ মনে হয়। আরো কিছুক্ষণ বসে সিকু। বহুদিনের পড়ে থাকা অ্যাসাইনমেন্টটা হাতে নেয় [মনে মনে]। প্রত্যাশিত হত্যার পরিকল্পনাটি এবার সে ফাইনাল করতে চায়। আসলে পরিকল্পনা নয়, অ্যাকশনটাই চূড়ান্ত করতে চায় সে। ভাবে আজই যদি করা যায় মন্দ হয় না? অন্তত চেষ্টা করতে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। আর বেশিদিন ফাইল চাপা থাকলে পরিকল্পনাটির অপমৃত্যুও ঘটে যেতে পারে। সিকু উঠে দাঁড়ায়। হাঁটুর ব্যথার ফাইলটা উধাও হয়ে যায় তার অজান্তেই।
ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে সিকু। থেমে রাস্তা পার হবার অপেক্ষা করে। পরপর কয়েকটি বিরতিহীন গাড়ি গতি ধামিয়ে তাকে ওঠার আমন্ত্রণ জানায়। সে কিছু বলে না। বিরক্ত হয়। এগুতে এগুতে একটা অলিখিত-দরকারি অভিধানের খসড়া তৈরি করতে থাকে, মনে মনে :
অনুমতি = অনাজ্ঞা, অনাদেশ, অসম্মতি
[‘অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’খচিত ব্যর্থ কথামালা মনে করে]।
বিরতিহীন = ক্ষান্তি, বিরাম, অবসান [কর্মবিরতি],
[থেমে থেমে চলা ‘বিরতিহীন’ গাড়িরাজি ভেবে ভেবে]
অতঃপর কয়েকমুহূর্ত কিছুই ভাবতে পারে না, সুনসান। বাংলা বর্ণক্রম [অ...] ঠিক না রেখে ইংরেজি বর্ণক্রমে [বি] পদার্পণে [না-কি হস্তার্পণ অথবা মনার্পণ]-র অপরাধবোধে ক্লান্ত হয় সে। বিরতিহীন পথহাঁটায় অভিধান-খসড়া তৈরিতে বিরতি দেয় সিকু।
পাঁচটা গোলাপ কিনে লাজুক প্রেমিকের মতো মুঠো করে এগুতে থাকে পিজি-র গেটের দিকে। একটা ট্যাক্সি নেবে ভাবে। তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত টার্গেট। কয়ধাপ এগুতে না এগুতেই আকাশ ফাটানো একটা টানা চিৎকার ছুঁড়ে খোয়াওঠা রাস্তায় আছড়ে পড়ে সিকু। রক্তের স্রোত স্পষ্ট চোখে পড়ে তার। চোখ ঝাপসা হতে থাকে। ছোট হতে থাকে তার পৃথিবী। মৃত্যুর পর্দাতোলা দরজায় দাঁড়িয়ে সে শুধু মনে করতে থাকে কয়টি পিপঁড়ার অপমৃত্যু, দেরিরোগগ্রস্ততা, ছাদকুমড়ার সংকীর্ণ ভুবন, মাল্টি প্রোডাকশন কোম্পানি, নাবিতার নাম, ফোনের বোতাম, ‘নীরবে’র মূল্য তালিকা, সেই টানটান টিলা, ফাইভ ফাইভের বৃত্তাকারে ধোঁয়া, ময়লাজমা ড্রেন, রমনার স্থির পানি আর বিরতিহীন পথচলা। অতঃপর সিকু নিজের মতো করেই শেষ ইচ্ছ ব্যক্ত করে [অবশ্য তা অব্যক্তই থাকে : ‘হে ঈশ্বর, পুনর্জন্মে আমি যেন একটা সাদা কবুতর কিংবা পূর্ণপৃষ্ঠা সাদা কাগজ হবার অনুমতি পাই।’
রাইজিংবিডি.কম