ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ফুলে ফুলে সেজেছে ঢাকা কলেজ

রায়হান হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৫ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফুলে ফুলে সেজেছে ঢাকা কলেজ

ঋতু রানি শরৎকাল। বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন (আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) মিলে শরৎকাল। এ সময় নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়, তবে তখনও মাটিতে থাকে বর্ষার সরসতা।

ভাদ্র (সেপ্টেম্বর) মাসে তাপমাত্রা আবার বৃদ্ধি পায়, আর্দ্রতাও সর্বোচ্চে পৌঁছে। শরতে ভোর বেলায় ঘাসের ডগায় শিশির জমে। শরতের শেষে রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি সুন্দর ও সুগন্ধি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। এ সময় তাল গাছে তাল পাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজাও এ সময় অনুষ্ঠিত হয়।

সম্প্রতি ঢাকা কলেজের মূল ফটকের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করা হয়েছে। সেই সময় মূল ফটকের দুই পাশে কলাবতী ফুল গাছ রোপণ করা হয়। বর্তমানে কলেজের দুই পাশেই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কলাবতী ফুল ফুটে রয়েছে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পথচারীদের এই ফুল একটু প্রশান্তির আভাস দিয়ে যায়।

কলাবতী ফুল:

কলাবতী ফুলকে বাংলায় সর্বজয়া, বৈজয়ন্তীও বলা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে saka siri, Indian shot, canna, bandera, chancle, coyol, platanillo বলা হয়। কলাবতী ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম হল ‘Canna indica’।

কলাবতী বর্ষার ফুল হলেও শরৎকালের সম্পূর্ণ সময়টা জুড়ে দেখা দেয়।  কলাবতী ফুল-হাসিতে মুগ্ধ হয়ে রবি ঠাকুর যার নাম দিয়েছিলেন ‘সর্বজয়া’। কলাবতী যেকোনো পরিবেশে বেশ স্বাচ্ছন্দে বেড়ে উঠতে পারে। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জন্মে। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে কিংবা শহরের বিলাসী বাগানে লাল-হলুদ এবং লাল ও হলুদ মেশানো কলাবতী ফুল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এদের আদিভূমি হচ্ছে ক্যারিবীয় অঞ্চল ও আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চল। বর্ণবৈচিত্র্য ও দীর্ঘ স্থায়িত্বের কারণে এই ফুল এখন উদ্যানেও নিজেদের স্থান করে নিয়েছে।

 

কলাবতী ও নয়ন তারা ফুল

কলাবতী একটি কন্দ জাতীয় বহুবর্ষজীবী, একবীজপত্রী উদ্ভিদ। গাছ ৩-৪ ফুট উঁচু হয়। কাণ্ড বিরুৎ জাতীয় সবুজ রঙের এবং মসৃণ। পাতার গঠন অনেকটা কলাপাতার মতো কিংবা হলুদ পাতার মতো। তাই এর নাম কলাবতী। পাতা উপবৃত্তাকার, ২০-৬০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ১০-৩০ সেমি চওড়া সবুজ ও তামাটে। পাতার অগ্রভাগ ক্রমশ সুচালো এবং গোড়ার অংশ কাণ্ডকে ঘিরে থাকে।

ফুল ফোটার সময় বর্ষা হলেও বর্ষার আগে পরে অনেকদিন ফুল থাকে। ফুলের রঙ সাধারণত লাল, হলুদ বা লাল-হলুদ মেশানো হয়। লম্বা পুষ্পদণ্ডের অগ্রভাগে গুচ্ছাকারে ৬-২০টি ফুল ফোটে। ফুলের আকৃতি গোড়ার দিকে সরু অগ্রভাগ ছড়ানো। ফুলে ৫টি পাপড়ি দেখা গেলেও সেগুলি আসল পাপড়ি নয়। পুংকেশর পরিবর্তিত হয়ে ছদ্ম পাপড়ির রূপ নেয়। আসল পাপড়ির সংখ্যা ৩টি, ছোট পাতার মত দেখতে, ৪-৬ সেমি লম্বা। যা এই নকল পাপড়ির নিচে থাকে। ফুল দেখতে ক্লীব জাতীয়।

শিউলি ফুল:

স্থানীয় নাম শেফালি, বৈজ্ঞানিক নাম-Nyctanthes arbor-tristis. এর আদিবাস ভারতে, তবে বাংলাদেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়।

শিউলি ফুল প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর আগমনী উপহার হিসেবে আমরা পেয়ে থাকি। শিউলির সৌন্দর্য ও মিষ্টি ঘ্রাণের কোনো তুলনা হয় না, মন কাড়ে। শিউলি ফুলের আরেক নাম শেফালি। শিউলি ছাড়া শরৎ একেবারে মৃত বা নিষ্প্রাণ অনায়াসে বলা যায়। আবার শরৎকালীন উৎসবও অনেকাংশ অপূর্ণ। ছোট্ট লাল সাদার শিউলি।

 

 

ভোরের কুয়াশা ঢাকা, আর শিশির ভেজা মাটিতে ফুল ফুটে ঝরে পড়ে। তখন ফুলগুলো দেখতে দারুণ লাগে। মনে হয়, ফুলগুলো গাছ তলায় নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। দূর থেকে মনে হবে স্বর্গ। আর শরৎমাখা শিশিরের পরশ, আর ভোরের শিউলি তলায় হিন্দু সম্প্রদায় তরুণ-তরুণী ও মাঝ বয়সের মায়েরা শিশির ভেজা মাটিতে ঝরে পড়া ফুলগুলো পূজা-অর্চনার জন্য ডালিতে জমায়।

অনেক কবি-সাহিত্যিক শিউলি ফুল নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। শিউলি ফুলের মালা খোঁপার সৌন্দর্য বাড়াতেও সাহায্য করে। শিউলি ফুল একদিকে সৌন্দর্য বাড়ায়, আরেক দিকে পাতা ও বাকল বিভিন্ন রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে থাকে।

গন্ধরাজ ফুল:

গন্ধরাজ ফুলের বাংলায় আরেকটি নাম হল গুলচন্দ। ইংরেজিতে একে বলা হয়- Gardenia, Cape jasmine, Bush Gardenia, Bunga Cina, Danh-danh বৈজ্ঞানিক নাম - Gardenia jasminoides

‘খদ্দরের সবুজ রঙের চাদরে ঢাকা সংকীর্ণ লোহার খাট ঘরের প্রান্তে দেয়াল-ঘেঁষা। নারায়ণী স্কুলের তাঁতে-বোনা শতরঞ্জ মেঝের উপর পাতা। একধারে লেখবার ছোট টেবিলে ব্লটিং প্যাড; তার একপাশে কলম-পেনসিল সাজানো দোয়াতদান, অন্যধারে পিতলের ঘটিতে গন্ধরাজ ফুল।’ – চার অধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আকাশের শরীরে লেপটে আছে কালো শাড়ি। চারিদিকে অফুরান প্রাণের উৎসব। নানা বাহারি ফুলে ছেয়ে রয়েছে চারপাশ। রিমঝিম-রিমঝিম বৃষ্টি আর ফুলের গন্ধ একাকার হয়ে বাতাসে ভাসতে থাকে। গন্ধরাজ বাংলার এক সুপরিচিত ফুল। যাদের শৈশব-কৈশোর গ্রামে কেটেছে তাদের সুখ-স্মৃতিতে এই ফুলের সুগন্ধ দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকবে। এক সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এগাছ চোখে পড়ত। আজকাল ঠিক ততটা না হলেও কিছু কিছু গাছ দেখা যায় পুরনো বাড়িগুলোতে। সহজলভ্যতা, পুষ্পপ্রাচুর্য এবং দীর্ঘস্থায়িত্বের কারণে এই ফুল গ্রামেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। গাছটি গঠন বিন্যাস ও ফুলের সুগন্ধের জন্য সর্বত্রই সমাদৃত।

 

 

গন্ধরাজ আমাদের পরিবেশে এমনভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, যে এ ফুল একদা চীন থেকে এসেছে তা বিশ্বাসই হয় না। এটি পাকিস্তানের জাতীয় ফুল। গন্ধরাজ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। গাছের দৈর্ঘ্য সাধারণত ২-৮ ফুট হয়। তবে প্রায় ১০-১২ মিটার অবধি লম্বা হতে পারে। স্বভাবে ঝোপালো, ডালপালাগুলো আঁটোসাঁটো ও শক্ত ধরনের। কখনো কখনো গোড়া থেকেও ডালপালা গজায়।

গন্ধরাজ চিরহরিৎ গাছ। পাতা লম্বায় ৩-৬ ইঞ্চি চওড়ায় ১ - ১.৫ ইঞ্চি অবধি হয়, বিপরীত জোড়ে গজায়। পাতা বল্লমাকার, কিনারা মসৃণ। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ ও উপরিতল তেলতেলে।

গন্ধরাজ ফুল পবিত্রতা, ভদ্রতা প্রভৃতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোলাপের মতো দেখতে বলে শ্বেতগোলাপ নামেও পরিচিত। শাখার অগ্রভাগ বা কক্ষ থেকে এককভাবে ফুল ফোটে। ছয় থেকে বারোটি পাপড়িতে বিন্যস্ত থাকে গন্ধরাজ।

ঢাকা কলেজের বাগানের পরিচর্যায় দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর ধরে কাজ করেন মুন্না। বাগানের মালি মুন্না প্রতিবেদককে দীর্ঘ সময় ধরে কলাবতী, শিউলি, গন্ধরাজ, টিকোমা, ইত্যাদি ফুলের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

 

 

তিনি বলেন, ‘এই বাগানের সাথে আমার জীবন জড়িত আছে, এই বাগান কে আমি তিল তিল করে গড়ে তুলছি, অবশ্য আমার সাথে আরো অনেক সহযোগী কাজ করেন।’

সবকিছু ছাপিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, দর্শনার্থী সবাইকেই বাগানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এই ফুলের সৌন্দর্যের মায়ায় একনজর থমকে দাঁড়াতেই হয়। কেননা সৃষ্টিগতভাবেই ফুলের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের অমোঘ বন্ধন। তাই ফুলের জাদুকরি বৈশিষ্ট্য মানুষকে সহসাই কাছে টানে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।



ঢাকা কলেজ/রায়হান হোসেন/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়