ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

প্রথম পর্ব

গন্তব্য জানা ছিল না

সুপন সিকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১৫ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গন্তব্য জানা ছিল না

আবারও নতুন সূর্যের আলো। সকালের মিষ্টি রোদে প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত লাগছে। করমচার ডালে পড়েছে রোদের আলো। গা জুড়ানো বাতাস আর সূর্যের আলোয় করমচা ফলকে মনে হচ্ছে হীরের এক একটি টুকরো। সে এক মহা কাব‌্য। যশোর ঘুরে এসেছি অনেক দিন হল। আজ কেন জানি না কাজী নজরুলের ওই গানের লাইনটি মনে পড়ে গেলো ‘তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সে জানে তোমারে ভোলা কি কঠিন’। আজ এই লাইনটি মনে বড্ড বেজে উঠছে। কারণ যশোরকে আমি ভুলতে পারিনি।

যশোরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সেখানকার মানুষের প্রেমে পড়েছি অজান্তেই। তাই যশোর নিয়ে না লিখলে ওটা হবে আমার প্রাণের বিরুদ্ধে যাওয়া। প্রিয় স্থান সম্পর্কে তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আজ লিখতে বসেছি। বড় ভাইয়ের আমন্ত্রণেই যশোরে যাওয়া। সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়ে ছিলো যশোর সার্কিট হাউজে। সার্কিট হাউজের সুসজ্জিত কক্ষ এবং সার্কিট হাউজের সবুজ চত্বর আমাকে প্রথমেই মুগ্ধ করেছে।

ওখানে আমার সময়গুলো দারুণভাবে কেটেছে। আমার সাথে ছিলেন রাজু, বদিয়ার এবং বদরুল ভাই। সার্কিট হাউজের বাবুর্চি আকরাম ভাইয়ের কথা না বললে আমার বড় অপরাধ হবে। একজন দুর্দান্ত রন্ধনশিল্পী এবং সর্বোপরি একজন সুন্দর মনের মানুষ তিনি। আকরাম ভাইয়ের হাতের রান্না অন্য সবার হাতের রান্নার চেয়ে সেরা। আমি বরাবরই একজন ভোজন প্রেমী মানুষ। খেতে খুব পছন্দ করি।

আমার মতে ভালো রান্না তারাই করতে পারেন, যারা সুন্দর মন নিয়ে রান্না করেন। রান্না হচ্ছে একটি আঁকা ছবির মত। একজন চিত্র শিল্পী ক্যানভাসে প্রকাশ করে তার আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না, দুঃখ এবং কষ্ট। ঠিক তেমনি একজন রন্ধনশিল্পীর ক্যানভাস হচ্ছে তার কড়াই, সেখানেই তিনি প্রকাশ করেন তার সকল ভাবনা। আকরাম ভাই কোনো দিন খাইয়েছেন রাজ হাঁসের মাংস, কোনো দিন ইলিশ পাতুরি, আবার কোনো দিন সেই বিখ্যাত খাসির চুই ঝাল।

যশোরে আমার ঘোরার অন্যতম এবং প্রধান সাথী ছিলেন বাবু ভাই। বাবু আমার বড় ভাই প্রীতম সাহার ড্রাইভার। দারুণ প্রাণবন্ত ছেলে। সবসময় হাসি খুশি থাকেন। বাবু ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করেন। তার সাথেই আমি যশোর জেলা শহর এবং শহরের আশপাশ ঘুরে বেড়িয়েছি। হঠাৎ এক পড়ন্ত বিকেলে আমাদের গন্তব্যহীন এক পথচলা। যদিও গন্তব্যহীন, তবে পথ ঠিকই খুঁজে নেয় গন্তব্য। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আমি চিনেছি তার লেখা কপোতাক্ষ নদ কবিতার মধ্য দিয়ে। আমরা অজান্তেই চলে এসেছি সাগরদাঁড়ি গ্রামের দত্ত বাড়িতে।

 

 

দত্ত বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে প্রাচীন পুকুর। পুকুরের চারদিকে প্রাচীন নানা প্রজাতির গাছের সমাহার। আরেকটু ভেতরে ঢুকতেই হাতের ডানদিকে চোখে পড়ে মধুকবির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। আবক্ষ ভাস্কর্যের পেছনেই মধুকবির স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ি। যা কিনা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মধুকবির বাড়িটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত রয়েছে। বাহির বাড়িতেই ছিল কবির কাচারি ঘর। এটি এখন পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পাঠাগারে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম কবির নিজের লেখা বইসহ কবিকে উৎসর্গ করা অসংখ্য বইয়ের সমাহার। আমি কিছুক্ষণ পাঠাগারের বই উল্টে পাল্টে দেখলাম এবং অবাক হলাম। একজন মানুষ কতো বড় সাধক হলে এত কবিতা, গল্প, নাটক এবং উপন্যাসে কতো নতুন নতুন শব্দ ব‌্যবহার করতে পারেন, তা আমার ভাবনায় আসে না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত  যেন একাই একটি নদী। আমরা সেই নদীর বুকে বয়ে চলা একটি নৌকো মাত্র।

পাঠাগার থেকে বেরুতেই আমার চোখ পড়লো পুকুর ঘাটের পাশেই একটি আমগাছ। আম গাছটি পুকুরের সিঁড়িগুলোকে ঢেকে রেখেছে অনেকটা মায়ের আঁচলের মত। মা যেমন সন্তানকে রোদ-বৃষ্টি থেকে আগলে রাখেন, ঠিক তেমনি আমগাছটিও পুকুর ঘাটকে আগলে রেখেছে। পুকুর ঘাটের দিকে এগোতেই লক্ষ করলাম কারা যেন জলে খেলা করছেন। জলের কাছের দুটো সিঁড়িতে শিউলি পড়েছে। আমি সিঁড়ি বেয়ে জলের কাছে আসতেই জলে আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। হঠাৎ করেই জল ঝাপটানিতে আমার প্রতিচ্ছবি আর দেখতে পেলাম না। আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কারা জলে খেলা করছিল। তারা আমাকে দেখেই লুকিয়ে পড়ল। এ যেন লুকোচুরি খেলা। আমি খানিকটা হাসলাম এবং একটু মুগ্ধও হলাম অসংখ্য মাছের লেজ ঝাপটানি দেখে।

পরে এগোতে লাগলাম কবির বাড়ির দিকে। বাড়িতে ঢোকার গোলাকার গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ পড়লো কবির পারিবারিক মন্দিরের দিকে। ধারণা করা হয় এই মন্দিরে দুর্গা পূজা হত৷ মন্দিরের দুই পাশে দ্বিতল ভবন এবং পেছনে অন্দরমহল, যেগুলো বর্তমানে জাদুঘর। মন্দিরের সামনে অসংখ্য ফুলের গাছ। মন্দিরের সিঁড়ি দিয়েই বাড়িতে প্রবেশের পথ।

কবির বাড়িটি নির্মাণে ব্রিটিশ আমলের চুন-সুরকি ও ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। ঘরে ঢুকতেই ঘরের ডান কোণে একটি কাঠের ছাপ বাক্সের উপর আমার চোখ পড়ল। সেখানে একটি কাঠের সিন্দুকও রয়েছে। সিন্দুকের গায়ে খোদাই করে নকশা করা কারুকার্য যেকারো চোখ জুড়াবে। তার পাশে একটি কাচের বাক্সে রাখা কবির কলকাতা বাড়ির ছবি ও কবির পারিবারিক কিছু থালা বাটি। ডান পাশের ঘরে কবির ব্যবহৃত একটি কাঠের আলমারি ও কিছু পাথরের আসবাবপত্র এবং একটি গ্রামোফোনও রয়েছে৷ গ্রামোফোন হচ্ছে একধরনের গান শোনার যন্ত্র। যেটা দিয়ে মধুকর গান শুনতেন। গ্রামোফোনে পাশে রাখা আছে কবির টুপি রাখার বাক্স। ঘরের ডান দিকে কবির খাট, টেবিল, আয়না, আলনা এবং একটি লোহার সিন্দুকের খচিত নকশা দেখার মত। এগুলো ছাড়াও জাদুঘরটিতে স্থান পেয়েছে স্টিলের বাক্স, প্রাচীন দা, টিফিন বাক্সসহ কবির নানা ছবি, কবিতা, নাটক, ইত্যাদি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ‌্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।



এসইউবি/সুপন/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়