ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

জীবন যুদ্ধে এক মা

নাবিল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ২০ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবন যুদ্ধে এক মা

২০১২ সালের কেনো একটি ভয়াল রাত। চার চারটি সন্তানকে বুকে আগলে রেখে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন একজন মা। আর অন্যদিকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এক এক করে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তার স্বামী। মৃত্যু যেন ঘড়ির কাঁটার সাথে টিক টিক শব্দ করে এগোচ্ছে।

ভোর হতে না হতেই বাতাসের সাথে রানার কাছে ভেসে আসলো একটা সংবাদ, মৃত্যুর সংবাদ। সকল বিশ্বাসের দরজায় তালা দিয়ে মনটা যেন বারবার শুনতে চায় এ সংবাদ ‘মিথ্যা’ এবং মানুষ ‘চিরঞ্জীব’। সেই মা ‘স্বামী গো' বলে যেই না চিৎকার দিল, অমনি সবাই পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে দিল মৃত্যুর বিচ্ছিরি গন্ধ। মাস দু'য়েক যেতে না যেতেই ওই মাকে যে-কেউ পরামর্শ দিতে থাকলো নতুন করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে, যাতে বাকি জীবনটা সহজ হয়।

মা ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লেন। মুখের উপর বলে দিলেন, আমার সন্তানরাই আমার সোনা-মানিক, আর বাকি জীবনের চলার পথের পাথেয়। এভাবেই দিন কাটতে থাকে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে।

বাবার রেখে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঋণের বোঝা ওই মায়ের ঘাড়ে বেজায় চেপে বসেছিল। যাদের টাকা ফেরৎ দেয়া হয়েছিল, তারাও সুযোগে পুনরায় টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, সেটা কি ভুলার মতো! রোজ রোজ একই খাবার খাওয়া, অকারণেই বাড়িতে বসে থাকা যেন জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যেই আটকে পড়েছিলেন মা। ঘরের পতি মারা গেলে যে আমাদের সমাজ আজও কোনো একা মহিলাকে সমীহ করতে শেখেনি, এটাই বলা বাহুল্য।

ওই ‘মা’ পথ চলতে চলতে কত যে হোঁচট খেয়েছেন, আর সামাজিক মিথ্যা ভৎসনা পেয়েছেন, তা শব্দে ব্যাখ্যা করা দায়। যাইহোক, এমনি করে দিন কেটে যাচ্ছিল। রাতে যখন সন্তানগুলো ঘুমিয়ে পড়তো, তখন ওই মা চোখের জলে ভাসাতেন বুক। এই কষ্ট মুছবার মতো নয়। যেন হৃদয়ের শক্ত পাথরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঁকা হয়েছে এই কষ্টের নীল নকশা। মাকে কখনো দেখা যায় দেয়ালে তার স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রুপাত করতে, আবার কখনো কখনো আশায় চোখের মণি উজ্জ্বল করে তুলতে। আর এভাবেই চলতে থাকে পৃথিবী নামক গ্রহের ছোট্ট একটা কোণের ছোট্ট একটা মঞ্চে জীবন্ত ট্র্যাজেডি নাটকের ধারাবাহিক মহড়া। কভু কী দেখা দেবে এই ধু ধু মরুভূমির মতো সংসারের বুকে অঝোর বৃষ্টির মিলন!

এভাবে আশায় বুক বেঁধে চলে যায় আরো কয়েকটা বছর। তার ছেলে-মেয়েগুলো আরেকটু বড় হয়। পড়াশোনায় নিয়মিত হয়, মায়ের কথা শোনে, একটু দায়িত্বশীল আচরণ করতে শেখে। ওই মা একহাতে সমস্ত সংসারের ভার বহন করে সন্তানদের পড়াশোনায় উন্নতি করতে থাকেন। এর মাঝে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। আজ তার বড় ছেলেটি বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, একমাত্র মেয়েটিরও বিয়ে হয়েছে একজন সুপাত্রের সাথে, আর ছোট্ট ছেলেটিও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। বলছিলাম আমার মায়ের জীবনের গল্প।

মায়ের তীব্র প্রচেষ্টায় আমি আছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হ্যা, আমিই ওই মায়ের সৌভাগ্যবান এক সন্তান। এই মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ না করলে আমি হয়তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন মাকে দেখার সুযোগ হারাতাম। মা শিখিয়েছেন, কখনো হেরে যেতে হয় না। মা আরো শিখিয়েছেন মানুষের খুবই সূক্ষ্ম জীবনবোধ। তবে, এ বিজয় আমার মায়ের একার নয়। আমার প্রয়াত বাবার আদর্শ আর আমার চাচা, ফুপি আর নানা-নানিদেরও বটে। উনারা শান্তির স্বর্গদূত হয়ে পাশে না থাকলে আমরা কবেই সামাজিক টানা-পোড়েনে নিষ্প্রভ হয়ে যেতাম।

বড় হয়েছি চাঁদপুরের দুর্গাপুর গ্রামে। জীবনের ক্রান্তিকালীন সময়টা দুর্গাপুরে কাটলেও এর আগের সময়গুলো ছিল ততটাই রঙিন। বাবা সেনাসদস্য হওয়ার সুবাদে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে থেকেছি আমরা। জীবনতন্ত্রের চরম জটিলতা তখনো গ্রাস করতে পারেনি আমাদের পরিবারকে। একসময় বাবা অবসরপ্রাপ্ত হয়ে পুরো পরিবার নিয়ে চাঁদপুরে চলে আসলেন। শেষ জীবনের পূর্বে বাবা দুই বছর বিদেশে কাটিয়েছিলেন।

আজও মা সামনের দিকে হেঁটে চলেন দীপ্ত প্রত্যয়ে। মা আজও স্বপ্ন দেখেন। না, অনেক অনেক টাকা পয়সার নয়। স্বপ্ন দেখেন আমাদের সুখ ও সমৃদ্ধির। মায়ের জন্য মনের গভীর থেকে দোয়া আর ভালোবাসা রইল।

তুমি আমার জীবন পথের শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়,

মা গো তুমি জিততে শিখিয়েছ অযথা হারতে নয়।

এমনি করে থাকবে বল ছায়া হয়ে,

স্বপ্ন তোমার সত্যি করবো কল্যাণে আর জয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ঢাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়