ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘মানুষের অর্থনৈতিক দূরত্ব দেখলাম নিজের চোখে’

মুজাহিদ উদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৩, ১৩ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘মানুষের অর্থনৈতিক দূরত্ব দেখলাম নিজের চোখে’

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কর্মরত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়রা সুলতানা রোশনী। তিনি ৩৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন সদস্য। সিভিল সার্ভিসে কর্ম জীবনের শুরুতেই করোনা সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রশাসনিক কাজ করতে হচ্ছে তাকে। এমন একজন মানুষের সঙ্গে তার কাজের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী এম এম মুজাহিদ উদ্দীন।

মুজাহিদ উদ্দীন: করোনার এই সময়ে নিজেকে কীভাবে মানসিকভাবে ভালো রেখেছেন?
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: আসলে আমাদের চাকরির ধরনটাই এমন যে, আমাদের সব সময় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল, তখন থেকেই মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সুবাদে নিজেদেরকে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তবে নিজেকে মানসিকভাবে ভালো রাখাটা আসলেই খুব কষ্টের কাজ, বিশেষ করে যখন পরিবারের সবাই ঢাকায় অবস্থান করে এবং দীর্ঘদিন তাদের সাথে দেখা না হয়। তারপরেও নিজেকে কিছু সময় দিয়ে মনকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা করেছি।

প্রথম দিকে খবরগুলো খুব ভালো করে দেখতাম প্রতিদিন। কিন্তু দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে মন খুবই বিচলিত হয়ে পড়ত। এমনকি দেশের বাইরের খবরগুলোও একই রকম মনে নাড়া দিত। তাই আস্তে আস্তে খবর দেখা কিছুটা কমিয়ে দেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা বই পড়া শুরু করি। আমার দেখা নয়াচীন পড়ে শেষ করি। এমনকি বিভিন্ন ড্রামাও দেখি। এই প্রতিটি কাজই আমাকে অনেক বেশি মানসিক সাহস জুগিয়েছে।

মুজাহিদ উদ্দীন: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাইরের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: প্রথম দিকে মানুষকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে বোঝানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্য সচেতনতা অনেক কম বোঝে। যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার এবং হাত ধোয়ার বিষয়গুলো বোঝাতে আমাদের মিনা কার্টুন লেগেছিল, সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বোঝানো অনেক বেশি কঠিন ছিল। তারপরেও তাদেরকে বিভিন্নভাবে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

মুজাহিদ উদ্দীন: জনসাধারণের সহযোগিতা কেমন পাচ্ছেন?
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান, বাজার কমিটির সদস্যরা অনেক সহযোগিতা করেছে আমাদের এ কাজে। লিফলেট বিতরণ, মাইকিং করা, মসজিদ-মন্দিরে বারবার বলে তাদেরকে আমরা সতর্ক করার চেষ্টা করি। বেশির ভাগ সময়ই জনসাধারণের সহযোগিতা পেয়েছি।

মুজাহিদ উদ্দীন: করোনার এই সময়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা?
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: মাঠ পর্যায়ে কাজ করার কারণে পুরো সময়টি আমাদের জনসাধারণের কাছাকাছি অবস্থান করতে হয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইন থেকে শুরু করে বাজার মনিটরিং সব কিছুই আমাদের প্রতিদিন দেখতে হয়েছে। মোবাইল কোর্টে যেতে হয়েছে প্রতিদিন। এমনই একটি মোবাইল কোর্টের সময় আমার সাথের পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর আমাকে বললেন, বাইরে থেকে কিছু লোক এসেছে ৪-৫ দিন হলো। আমি বললাম ঠিক আছে, দেখে আসি তারা ঠিকমতো হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করছে কিনা।

তাদের বাড়িটি সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, দেখলাম, বাড়ির বাইরেই কয়েকজন ঘোরাঘুরি করছে। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে আমার সন্দেহ  হলো। জিজ্ঞেস করাতে বলেন, তিনি সিলেট থেকে এসেছেন মৌলভীবাজার। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদে বের হলো, তিনি ১৪ দিন আগে লন্ডন থেকে এসেছেন। আমরা যে বাড়িতে খোঁজ নিতে এসেছি, তিনি ঐ বাড়িতেই এসেছেন। বাড়িতে যাওয়ার পরে যাদেরকে দেখার জন্য এসেছি, তাদেরকে বাইরে আসতে বললাম। এর মধ্যে যিনি পুরুষ ছিলেন, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ১৫ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন তিনি ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন না, তখন সাব ইন্সপেক্টর সাহেব ঘরে গিয়ে লোকটির নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন।

তার কিছুক্ষণ পরে তিনি হতদন্ত হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে আসলেন। কোথায় ছিলেন জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানালেন, তিনি মাছের খামারে ছিলেন কিন্তু তিনি হোম কোয়ারেন্টাইন ঠিকমতো পালন করছেন। খামার কত দূর জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, এই হবে ১ মাইল, কিন্তু আমি কোয়ারেন্টাইন ঠিকমতো পালন করছি। হাসব না কাঁদব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এই হল আমাদের প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে ধারণা।

মুজাহিদ উদ্দীন: চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এই সময়ে আপনার কী পরামর্শ?
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: আমি মনে করি, চাকরিপ্রার্থীদের এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ নিজেদেরকে শানিত করার জন্য। লকডাউনের এই সময়টি পুরোভাবে কাজে লাগিয়ে  ভালো প্রিপারেশন নেওয়া সম্ভব। দিনের সময়গুলোকে রুটিন করে ভাগ করে প্রতিটি বিষয়ের উপর দখল বাড়াতে হবে। এছাড়া ইংরেজি, গণিত বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুশীলন করতে হবে। যার যেই বিষয়ে দুর্বলতা আছে, তা কাটিয়ে ওঠার এখনই মোক্ষম সময়। যেহেতু প্রিপারেশনের জন্য এমন একটি বড় সময় চাকরিপ্রার্থীরা  পাবে না, তাই এর কোনো মুহূর্তই হেলায় পার করা উচিত নয়। ফেসবুক বা অন্য কোনো কাজে সময় নষ্ট না করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এই সময়টি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পরামর্শ দিব আমি।

মুজাহিদ উদ্দীন: করোনা পরিস্থিতিতে কাজ করায় আপনার কোনো অভিজ্ঞতা যদি আমাদের বলেন।
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: করোনার এই পরিস্থিতির প্রথম থেকেই মাঠ পর্যায় কাজ করার কারণে ভালো-খারাপ নানা রকম মিশ্র অভিজ্ঞতা পেয়েছি। আমাদের চাকরির খুব অল্প সময়েই জাতীয় সংকট মোকাবিলার এমন একটি দায়িত্ব পালন আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবুও আমরা সবাই মিলে তা কঠোর হাতে সামাল দিতে পেরেছি।

এর মধ্যে একটি ঘটনা এমন ছিল যে, আমি মোবাইল কোর্টে গিয়েছি, দেখি একটি স্বর্ণালয় খোলা। ভিতরে গিয়ে দেখি, সেখানে দুইজন মহিলা এবং একজন পুরুষ আছে, সাথে কারিগর। জিজ্ঞাসা করাতে বলে, হাতের ব্রেসলেট ঠিক করাতে এসেছে। আমরা এই ঘটনা দেখে খুবই অবাক। যেখানে মানুষ দু’মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছে, সেখানে তারা অলংকার ঠিক করাতে এসেছে। আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দূরত্ব দেখলাম নিজের চোখে। নিজেকে একদিকে যেমন অসহায় লাগছিল, তেমনি এমন দুর্দিনে মানুষের বিলাসিতা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম।

মুজাহিদ উদ্দীন: জনসাধারণের উদ্দেশ্যে করোনা মোকাবিলায় আপনার পরামর্শ কী?
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: আসলে জনগণকে পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। কেননা, এ পর্যন্ত সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমি তাদেরকে তবুও বলব, আপনাদের প্রতি যা বলা হয়েছে, তা সঠিকভাবে পালন করুন। আপনি হয়তো জানবেনও না যে আপনার কাছ থেকে আপনার পরিবারের কেউ আক্রান্ত হতে পারেন।

তাই স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মেনে চলুন সবাই। এই দেশ আমাদের, এ দেশের মানুষগুলোও আমাদের। তাই আমরা যদি সবাই নিজ নিজ পরিবারের যত্ন করতে পারি, তাহলেই পুরো দেশ সুরক্ষিত হবে। ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমরা আপনাদের জন্য ঘরের বাইরে আছি, আপনারা আমাদের জন্য ঘরে অবস্থান করুন। তাহলেই আমরা সবাই মিলে করোনার মতো রোগের সাথে লড়তে পারব।

মুজাহিদ উদ্দীন: আপনাকে ধন্যবাদ। সচেতন থাকবেন। নিরাপদে থাকবেন।
হুমায়রা সুলতানা রোশনী: আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনিও সচেতন থাকবেন।

 

জবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়