ঢাকা     শনিবার   ১১ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৮ ১৪৩১

গল্প

ঘুমন্ত বিবেক

আবদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০১, ১৮ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ঘুমন্ত বিবেক

‘একটু সহনশীল হন। নিজের বিবেক নাড়া দিন। নিজেও যে এক মেয়ের বাপ!’

বিকেল তখন ৩টা। চেয়ারম্যান বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন ২৪ বছর বয়সী কোহিনুর আক্তার। গ্রামের সবাই তাকে কোহিনুর আপা বলেই চিনে। গ্রামের অসহায়দের সুখ-দুঃখের সাথী কোহিনুর আপা। সমাজে বড় বড় ক্ষমতাবান ব্যক্তি থাকলেও কোহিনুর আক্তারই এগিয়ে আসেন মানুষের বিপদে। সমাজসেবিকা বলা চলে তাকে।

দরজায় কড়া নাড়তেই চেয়ারম্যান বাড়ির খাদিম মজনু দরজা খুলে বলে কাকে চাই? কোহিনুর উওর দিল, এটা তো চেয়ারম্যান কাশেম শিকদারের বাড়ি। -জ্বী। মজনু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উওর দিলো।

তার বাড়িতে তাকেই চাই, কোহিনুর আপার কথাটা শেষ হতে না হতেই মজনু বলে শিকদার সাহেব উপরের ওই ঘরটায় বসেন। এই বলে দোতলার প্রথম রুমটার দিকে আঙুল তুললো। আপনারা আসুন আমি ঘরটা খুলে দিচ্ছি।

শিকদার সাহেব সাড়ে ৪টায় এসে হাজির হলেন রুমে। সামনের চেয়ারেই বসে আছেন কোহিনুর আপা। শিকদার সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। আঁড় চোখে দেখেই নিজের চেয়ার টেনে বসলেন শিকদার চেয়ারম্যান সাহেব।

বসুন। বলুন তো কী সমস্যা আপনাদের? শিকদার সাহেব বলেন।

চেয়ারম্যানের চোখের দিকে দৃষ্টি করে কোহিনুর আক্তার বলেন, চেয়ারম্যান কাকু। পাশের পাড়ার কয়েকটি ছেলে আমার বোনের ইজ্জত নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আমি এর বিচার চাই। কোহিনুরের কথায় কেমন কাঁদো কাঁদো ভাব।

- প্রমাণ আছে কোনো?

- আমার বোনের বয়ানই তার প্রমাণ। জোর গলায় চেয়ারম্যান এর উওর। আরে বাপু! ধর্ষণ তো হয়নি। চুপ করে রইলেন কোহিনুর আপা। চুপ থাকতে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব কোহিনুর আপার দিকে তির্যক দৃষ্টি দিয়ে বলেন, নাকি হয়েছে? আরে বাপু যা হয়েছে সেটা খুলে বলো তো।

নাহ সেসব হয়নি, একটি পরিচিত ছেলে সময়মতো সেখানে উপস্থিত হওয়ায় এই যাত্রায় বেঁচে গেলো। কিন্তু করার তো চেষ্টা করেছে। সে ধস্তাধস্তিতে বোনের জামার হাতাটাও ছিঁড়ে গেছে। আমি দেখাচ্ছি আপনাকে। কোহিনুর আপা এসব বলেই বোনটার সামনে নিয়ে এসে দেখাতেই শিকদার সাহেব বলে ওঠে, ওসব দেখে আমার কোনো কাজ নেই। ধর্ষণ না হলে তো মেডিকেল প্রুফ ট্রুফ কিছু থাকে না। যাইহোক। বলছি কী, বোনের প্রেমিক-টেমিক নয় তো? প্রেম ঘটিত কিছু কি হয়েছে? বলেন শিকদার সাহেব।

তা কী করে। আমার বোন তো ওদেরকে চিনতোও না। থানায় রিপোর্ট লিখিয়েছেন? একটু হতাশা গলায় কোহিনুর আপা বলেন লিখিয়েছি। কিন্তু আমার ভরসা হচ্ছে ওই মানুষদের উপর। দারোগা সাহেব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, দেশে ধর্ষণকারীরা ধরা পড়ে না সেখানে এই কেইস কি ঠাঁই পাবে!

তা অবশ্যই ঠিক বলেছে। শিকদার সাহেবের উওর। তাহলে ঐ ছেলেদের কে শাস্তি দিবো কী করে! বিস্ময়সূচক প্রশ্ন কোহিনুর আপার।

কয়টা ছেলেপেলেকে নিয়ে ধমকিয়ে আসুন। বলতে বলতে মজনুকে ডাক দিলেন শিকদার সাহেব। এই মজনু বড্ড মশারে, কয়েলটা একটু জ্বালিয়ে দিয়ে যা। আবার কোহিনুর আপার দিকে দৃষ্টি করে বলেন, আগে নিজের ঘরে সামাল দিন। এমন ছেলে সমাজের আনাচে-কানাচে অনেক। কয়টাকে আপনি আটকাবেন? বলতে বলতে বাঁ হাতের উপর বসা মশাটাকে মেরে দিলেন। বোনকে একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলুন। শিকদার সাহেবকে থামিয়ে ভেতরে রাগকে চাপিয়ে কোহিনুর আপা বলে উঠলো, আপনি মশাটাকে মারলেন কেন? উড়িয়ে দিতে পারতেন।

আরে বাপু আপনার কি মাথায় সমস্যা আছে? মশাটা আমায় কামড়াচ্ছে আর আমি মারবো না! জোর গলায় বলেন শিকদার সাহেব। নাহ্ মানে একটা মশা মারলে তো আর সব মশাকে থামানো যাবে না। বলেন কোহিনুর।

আরে বাপু মশাটা আমাকে কামড়িয়েছে তাই যোগ্য শাস্তি দিয়েছি। চেয়ারম্যান বলল। তাহলে আমার বোনের সাথে ওরা যে অপরাধ করেছে, তাদের যোগ্য শাস্তি পাওয়া উচিৎ নয় কি? চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে কোহিনুর আপার প্রশ্ন।

এমন সময় মজনু মশার কয়েল এনে টেবিলের তলায় রেখে যেতেই চেয়ারম্যান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। হ্যা রে মজনু, তনিমা ঘরে ফিরেছে তো? না সাহেব। মজনুর উত্তর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বললেন, সাড়ে ৫টা বাজে‌। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এখনো এলো না। এমন তো দেরি করে না মেয়েটা। বলতে বলতে বসা থেকে উঠে গেলেন। সিঁড়ি দিকে এগোতেই দেখে হাঁফাতে হাঁফাতে আসছে চেয়ারম্যান সাহেবের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে তনিমা।

কিরে! এত দেরি যে তোর? হাঁফাচ্ছিস কেন? চেয়ারম্যান সাহেবে একটু রাগান্বিত গলায় প্রশ্ন করলেন। মেয়ে- আব্বু আমি তো প্রাইভেট পড়া শেষ করে আসছিলাম। মোড়ের বাঁকে আমার বান্ধবী রিমিকে বিদায় দিয়ে বাড়ির দিকে ফেরার পথেই একটা আঙ্কেল আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল। কাঁদতে কাঁদতে তনিমা বলল।

চেয়ারম্যান সাহেবের রাগ তখন কঠোর হতে লাগলো। তনিমাকে থামিয়ে কোহিনুর আপা বলতে লাগলো। তবে শুনুন। আমার মামাতো বোনের ব্যাপারে এসেছিলাম আপনার কাছে। আর আমার মামাই আজ আপনার মেয়েকে হাত ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিলো। আপনার বিবেকটাকে একটু নাড়া দিতে, অনুভব করাতে। যে নিজের মেয়ের সাথে কিছু সামান্য খারাপ হলে ঠিক কেমন লাগে।

সেদিন আমার মামা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলেন আপনার কাছে বিচার চাইতে। মনে পড়ছে আপনার? মনে না থাকার কথা। আপনি চেয়ারম্যান মানুষ। আশায় বুক বেঁধে এসেছিল সে নির্যাতিত মেয়ের বাবা। আপনি উনাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। সময় নেই বলে আপনি উনার অভিযোগও শুনেননি। কথাগুলো বলতে বলতে কোহিনুর আপা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।

চেয়ারম্যান সাহেবের বিবেক কতটা জাগলো তা বলা মুশকিল। তবে মাথা নিচু করে নিজের মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন। কোহিনুর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল আরেকটু সহনশীল হন চেয়ারম্যান সাহেব। আপনিও যে এই শকুনের সমাজে এক মেয়ের বাপ। মেয়ের বাপদের যে এমন অস্থির হলে চলে না।

নাহ! এটা আমার কথা নয়। থানার দারোগা সাহেবের কথা। রিপোর্ট লিখানোর দিন মামাকে তিনি বলেছিলেন আপনার নাকি চেনা-জানা সে শয়তানগুলো? চুপ করে থাকলো চেয়ারম্যান সাহেব।

আজকাল টিভি চ্যানেল চালু করলেই দেখা যায় ধর্ষণ আর খুন। রাস্তায় মেয়েদের নিরাপদে চলাফেরা মুশকিল হয়ে গেছে। শয়তানগুলো বাচ্চা মেয়েটাকে পর্যন্ত ছাড়ে না। আগে পুরুষ মানেই মেয়েরা বাবা-ভাইদের চিনতো। আর এখন পুরুষ মানেই ধর্ষকের কথা মনে ওঠে। ধর্ষক আর পুরুষ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আপনাদের মতো কিছু নেতাদের কারণে ওই শয়তানগুলো সুযোগ পাচ্ছে।

একটু বিবেক জাগ্রত করুন চেয়ারম্যান সাহেব। সঠিক বিচারে এগিয়ে আসুন, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান। বলে কোহিনুর আক্তার চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। দত্তপাড়া কলেজ।

 

লক্ষ্মীপুর/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ