ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘কৃষক হয়ে যাবো, চাষ করে খাবো’

নাবিল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩২, ২৯ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘কৃষক হয়ে যাবো, চাষ করে খাবো’

আঙুলের কর গুনে গুনে তিন মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলো লকডাউন শেষ হওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। পড়ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে, কিন্তু বই-খাতার সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় আজ যেন নিষ্কর্মা।

আসলে একজন ছাত্রের খাতাপত্রই তার মেধা চাষের দুই বিঘা জমি। নিজেকে বড়ই অসহায় আর সমাজের বোঝা মনে হচ্ছিল। দিনকে দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছিলাম। ভেবেই বসেছিলাম না খেতে পেয়ে বোধহয় মারা পড়বো। আর তারপরের গল্পটা আমাকে আজ একজন বলবান আর সফল ছাত্র হিসেবে ভাবাচ্ছে। আজ আমার পরিবার আর আমি একজন সফল কৃষক, উদ্যানচাষি আর মাঠফসলের বন্ধু।

গল্পটার শুরু মাসকয়েক আগে। আচমকা দক্ষিণা দমকা বাতাসের মতো ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরে আসলাম খুব কম প্রস্তুতি নিয়ে। নেই টিউশন, নেই উদ্ভাসের খাতা কাটার চরম ব্যস্ততা। তো খাবো কী দিয়ে? বাপ তো নেই। মা বাপের পেনশন দিয়ে নিজেকে আর ছোটভাইকে যেনতেন করে চালিয়ে নিতে অভ্যস্ত, কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের দীর্ঘ দিনের গৃহযাপনের চিন্তা যেন মার চোখে-মুখে দেখা গেলো।

সেই রেখার রেখাপাত করতেই আমার বড় ভাইকে হতে হলো কিয়ৎ চিন্তাবিদ। জমির ঝুলি তলানিতে। সুতরাং চাষের কথা ভাবাটাও যেন বড় মাপের কোনো উদ্যোগ। পারিবারিক আলাপের সেই রাতে সবাই মিলে কিছু একটা ভাবতে হবে বলেই জেঁকে বসা। হাতের মুঠোয় পারিবারিক কয়েক বিঘে জমি, আর ভিটির সামনে প্রসস্থ একটা উঠোন যেন মুস্কিল আসান। কিন্তু এ দিয়ে আর কত দিনই বা চলবে!

এদিকে মা করলেন আরেক কাজ। ঘরের মুরগির ডিমে তা দিতে বসিয়ে দিলেন ঘরের আদরের কালো মুরগিটাকে, আর আমরা ভাইয়েরা মিলে কবুতর পুষতে শুরু করলাম, যাতে আমিষের চাহিদা মেটানো যায়। পুকুরের মাছগুলোকে জেলে ডেকে তোলা হলো ফ্রিজের খোপে। যাতে দীর্ঘ দিন ধরে খাওয়া যায়। কিন্তু মাঠে কাজ করবো ভাবলেই প্রথম দিকে লজ্জা পেতাম। গলায় গামছা, পরনে লুঙ্গি আর হাতে কাস্তের ধাঁচে নিজেকে কেমন কেমন লাগবে, ভেবেই মন খারাপ করতো।

একজন শহুরে ছাত্রের কী এসব মানায় নাকি এমন ভাব। সময় যেতে যেতে মাঠের বপনকৃত বীজগুলোর রত্নপেটিকার মতন উঁকি দেওয়ার আনন্দে সব মিছিমিছি লাজলজ্জা ভৌ-দৌড়ে পালালো। ধীরে ধীরে মাঠে ফলতে লাগলো তাজা তাজা বরবটি, ঢেরস, পুইশাক আর সসিন্দা। খুব কাছ থেকে ওদের দেখি। যত দেখি ততই আনন্দ লাগে। প্রায় প্রতিদিনই শাকসবজি খাওয়া হচ্ছে।

বাসার ছাদের দিকে বিশেষ নজর দিয়ে বড় ভাইয়ের মাথায় আসলো আরেকটা চমৎকার বুদ্ধি। ভাই আমাকে বললো, নাবিল ছাদে কিছু চাষবাস করলে কেমন হয়? অতি উত্তম। সবাই মিলে ছাদের মাটি, গোবর সার আর ইটের বেড়ি দিয়ে তৈরি করলাম কৃত্রিম জমি। এখানেও করা হলো নানা সবজি চাষ। চাষের পরিসরটা যেন আরেকটু বড় হয়ে গেলো। দায়িত্বও আরেকটু বেশি।

এদিকে কবুতরের ডানা ঝাপটানোর বেলা শেষে নথর নথর বাচ্চা বেরুলো ডিম ফুটে। অপর দিকে মায়ের মুরগির তা দেওয়া ডিম থেকে বাচ্চা বেরুলো কয়েক দফায়। রাস্তার দু'ধারেও করা হলো চাষবাস। আমিষ, ভিটামিনের যবনিকাপাতে শর্করার বাসায় আজকাল টোকাটুকি চলছে। জমিতে বারদু'য়েক চাষ দিয়ে ধান বোনার তোরজোর চলছে সকাল-সন্ধ্যা। এই নিয়ে চলছে চাষের ধুমধাম।

কোথায় যেন শুনেছিলাম, যখন যেমন তখন তেমন হতে শেখা মানুষকে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ ধারণায় এগিয়ে রাখে। এদেশে এমনিতেই ২৭ শতাংশ কম প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে জন্ম নেয় একেকটি শিশু আর যথারীতি দিনশেষে জায়গা করে নেয় লাখো বেকারের প্রকাণ্ড তালিকায়। আর সেই তালিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে খুব কম সংখ্যকই হাতে নেয় স্টার্টাপ বা উদ্যোগ। তার উপর থেমে থাকা সময়ের রোষানল থেকে বেরুতে আমাদের সবার কতই না ভিন্ন ভিন্ন সংগ্রামের গল্প তৈরি হয়ে গেছে।

আমাদের গল্পটাও নাহয় একটু জায়গা করে নিলো। এত দিন পড়াশোনা করেছি। লিখার কিছুই পাইনি। আজ একটা গল্প তৈরি করতে পেরেছি। আজ যেন আমার ছাত্রত্ব সফল। অন্তত ভিন্নধর্মী আর মনের কিছু কথা তো লেখার রসদ পেলাম।৷ কম কীসে! বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী নাকি কয়েকগুণ বছর পিছিয়ে পড়েছে। পড়ুক, তাতে কী! সেই এগ্রারিয়ান সোসাইটি থেকে আজকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটিতে উন্নীত যেমন একটি ধারাবাহিক বাস্তবতা ঠিক এর বিপরীতকরণও বাস্তবতা হতেই পারে।

তাইতো বুক ফুলিয়ে বলতে চাই, কৃষক হয়ে যাবো, চাষ করে খাবো। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হাতে কাস্তে আর গায়ে গামছা যেন বহুলাংশে সাহস জোগায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ঢাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়