ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘দূষণ প্রতিরোধে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জরুরি’

ইমরান ইমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ১২ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
‘দূষণ প্রতিরোধে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জরুরি’

রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান। জনসংখ্যা ব্যতীত রাষ্ট্র গঠন কল্পনা করা যায় না। জনসংখ্যা একটি রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু অত্যাধিক জনসংখ্যা রাষ্ট্রের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে তখন রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্বের জনসংখ্যা যখন ৫ বিলিয়নের ঘরে পৌঁছাল, তখন জাতিসংঘের উপলব্ধি হলো অত্যাধিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এ জন্য জনসাধারণের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা। আর এ জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে একটি দিনকে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। আর সে দিনটি হলো ১১ জুলাই।

জনগণের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোই দিবসটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। অশিক্ষা, দারিদ্র্যের কারণে স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারেন না বহু মহিলা এবং তাঁদের পরিবার। সেক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের সময় বা পরে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে- বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মহিলা গর্ভধারণ বা প্রসব নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অতএব, প্রয়োজন পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান প্রদান করা এবং আরও বেশি সচেতনতা বাড়ানো।

জনসংখ্যাকে ‘সম্পদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও একবিংশ শতাব্দীতে প্রয়োজনের বেশি জনসংখ্যা বিশ্বের জন্য বোঝা। আর এ অত্যাধিক জনসংখ্যাই বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞের মতে অপুষ্টি, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি মৌল মানবিক সমস্যার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা।

পৃথিবীর জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২৫০টি শিশু জন্মগ্রহণ করে। গবেষকদের মতে পৃথিবীর যা সম্পদ রয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ২০০-৩০০ কোটি লোককে সঠিকভাবে জায়গা দেওয়া সম্ভব।

আর এ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতি ও পরিবেশে নিত্যনতুন যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য সমস্যা। বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে খাদ্যের যোগান নেই। অর্থাৎ, জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, আর খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে গাণিতিক হারে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে- প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫,০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিজনিত কারণে।

পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এছাড়া সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা, ওজোন স্তরের ক্ষয় ইত্যাদি বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিশ্বকে। তার উপর যুক্ত হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। আর এর মূলে রয়েছে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

পৃথিবীর জনসংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে গেলে বা অত্যাধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তখন প্রাকৃতিকভাবেই এর বিনাশ বা ধ্বংস হয়, (ম্যালথাস তত্ত্ব মতে)। আমরা বিশ্বজুড়ে এখন তারই বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। করোনাভাইরাস নামক মহামারিতে এখন পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এটা প্রাকৃতিক নিধনেরই বাস্তব উদাহরণ।

বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৭ বিলিয়নের অধিক। আর বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬০.৫ মিলিয়ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার। ২০১৮ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২২ কোটিতে পৌঁছাবে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচি বড় ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৫ সালে ৮ শতাংশ বিবাহিত নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ-সামগ্রী ব্যবহার করতেন। এখন ৬৬ শতাংশ নারী ব্যবহার করেন। সত্তরের দশকে ভারতে জন্মনিয়ন্ত্রণ-সামগ্রী ব্যবহারের হার ছিল ১০ শতাংশের মতো, এখন তা ৬০ শতাংশ। পাকিস্তানে এ হার ৩০ শতাংশ। প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও এখনো বাংলাদেশে দুর্গম অঞ্চল এবং চরাঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণ-সামগ্রীর অপ্রতুলতা রয়েছে।

বিশ্বের যেসব দেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্যে চীন অন্যতম। তারা কঠোরভাবে ‘এক সন্তান নীতি’ প্রয়োগ করেছে। কোনো নাগরিক তা না মানলে কঠোর শাস্তিরও বিধান রেখেছে। আবার অনেক দেশ বা অঞ্চল রয়েছে যারা চীনের মতো কঠোর পদক্ষেপ না নিয়েও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য অর্জন করেছে। শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম,ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এক্ষেত্রে তারা যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তার মধ্যে রয়েছে মানুষকে সুশিক্ষিত ও সচেতন করা, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা এবং জন্মনিরোধ পদ্ধতিগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। আশার কথা হলো সম্প্রতি বাংলাদেশ জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমবেশি সফলতা অর্জনকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

এই অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখনো একটি বড় সমস্যা। কেননা এখানে জনসংখ্যার ঘনত্বের হার সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে ঘাটতিসমূহ আমাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে বেকারত্ব; দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অশিক্ষার শিকার হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।

একটি দেশে জনসংখ্যা তখনই সম্পদে পরিণত হয়, যখন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা যায়। কিন্তু এ চাহিদাগুলো পূরণে এখনো বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকল্পনার অভাবে পুরো জনসংখ্যাকে কার্যকর জনসম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে বৈষম্য। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে এ ঘাটতিগুলো পূরণ করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে যাদের অধিকাংশ কর্মক্ষম। এই বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে যদি দক্ষ করে তোলা না যায়, তা হলে দেশের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির আরও একটি বড় সমস্যা হলো মানুষের রাজধানীমুখীতা। বর্তমানে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ৮০ লাখ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে ২ কোটি ৮০ লাখে। সরকারি সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগের প্রধান কার্যালয়, এমনকি বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান, প্রধান ও বিশেষায়িত সব হাসপাতাল, ব্যাংক, বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকায়। সঠিক পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবে বাংলাদেশের সব কিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে এবং দ্বিতীয় কোনো শহরে ঢাকার কাছাকাছি উন্নয়ন এখনো হয়নি। তাই জনসংখ্যা অনুপাতে কাজের সুষম বণ্টন ও সুষম উন্নয়নের স্বার্থে বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি হয়ে উঠেছে।

জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অত্যন্ত জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১ হাজার ১২৫ জনের বসবাসের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং সমস্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব সমস্যা ভবিষ্যতে আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। 

শিল্পায়ন ও নগরায়নসহ কেন্দ্রীয় অন্যান্য সব সুযোগ সুবিধার প্রাধান্যের ফলে মানুষের রাজধানীমুখীতা দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে রাজধানীর জনসংখ্যা। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। বর্তমানে ঢাকা শহর দূষণের তালিকায় এবং পৃথিবীর বসবাস অযোগ্য শহরের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। যা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। তাই পরিবেশকে রক্ষা করতে, দূষণ প্রতিরোধে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দিকে আমাদের বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে।

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে দেশের মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষায় জনগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

পৃথিবীর যে দেশ যত বেশি তার জনগণকে শিক্ষার সংস্পর্শে আনতে পেরেছে, সে দেশ তত বেশি মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের জন্য সম্পদ। কেননা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তাঁদের অধিকার, কর্তব্য, দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে। ফলে দেশের জনগণ শিক্ষিত হলে দেশ ও জাতির জন্য সামগ্রীক কল্যাণ বয়ে আনবে।

দেশের জনসংখ্যা অধিক হলেও সমস্যা নেই, যদি সে জনসংখ্যা দক্ষ হয় বা তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়। তাই আমাদের জনসংখ্যাকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের বিপুল জনসংখ্যাকে ‘জনসম্পদে’ পরিণত করতে পারবো। বিনির্মাণ করতে পারবো কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার বাংলাদেশ’।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

চবি/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়