সন্তানগুলো যেন ধর্ষক না হয়
শফিউল আল শামীম || রাইজিংবিডি.কম
আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং জঘন্যতম সামাজিক অপরাধের নাম ধর্ষণ। দেশের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছেই। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়েছে, যেন এটি ডাল ভাতের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিছুকাল আগেও আমাদের সামাজিক অপরাধগুলো কিছুটা ভিন্ন মাত্রার ছিল। যেমন- এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, অপহরণসহ নানা প্রকার জটিল অপরাধ। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগের বদৌলতে এসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। নারীর ক্ষমতায়নের প্রভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনাও মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় নেমে এসেছে। তবে ধর্ষণ কমেনি বরং বেড়েছে এবং বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। অতিমাত্রায় যেটি বাড়ছে, তা হচ্ছে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাকাণ্ড। কেননা, আইন প্রয়োগে হয়তো ধর্ষণ কিছুটা কমানো যাবে, কিন্তু কখনই নির্মূল করা যাবে না এটা বাস্তব।
সরকারি এবং বেসরকারি পরিসংখ্যানগুলো পর্যবেক্ষণ করলে আমরা ধর্ষণ সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেতে পারি। যেমন- বেশিরভাগ ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষণকারীর বয়স দেখা যায় ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বস্তুত এ বয়সটাই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট। অন্য বয়সী ধর্ষকের সংখ্যা এক্ষেত্রে খুবই নগণ্য। গবেষণায় দেখা গেছে ধর্ষণের পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে, তা হলো ছেলে সন্তানদের উপযুক্ত বয়সে বিয়ে না দেয়া এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাব। অনেকে আবার মনে করেন নারীর বেপর্দাই নাকি ধর্ষণের জন্য দায়ী। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যেখানে কোনো নারী বেপর্দার কারণে ধর্ষিত হয়েছেন। কেননা, ৬ বছরের কন্যা শিশুটিও এই নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হয়, এই বাচ্চা মেয়ে শিশুটির শরীরে পর্দা করার মতো কী থাকে?
সকল ধর্মেই বিবাহ প্রথা স্বীকৃত। বিবাহ একটি সামাজিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ পদ্ধতি। যেখানে একজন পুরুষ ও মহিলা সামাজিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরিবার গঠন করেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা বিবাহ প্রথাকে খুবই কঠিন করে নিয়েছি। বিবাহ বলতে এখন আমরা বুঝি ছেলেকে অবশ্যই চাকুরিজীবী হতে হবে, টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি থাকতে হবে। এসব না থাকলে ছেলের বাবাও ছেলেকে বিয়ে দেন না, আর মেয়ের বাবাতো বেকার ছেলের নিকট কোনো অবস্থাতেই মেয়ে বিয়ে দিবেন না। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বিয়ের কথা চিন্তা করা যেন একটি ছেলের জন্য অন্যায়। আর এ অন্যায়ের বোঝা মাথায় নিয়ে যখন সে সফলতার পেছনে ছুটে, তখনই জৈবিক প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে যায়। তখন সে হয় কোনো মেয়ের পেছনে ছুটে, না হয় নিষিদ্ধ পল্লিতে যায় অথবা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর সর্বশেষ যে ফলাফলটি আমরা দেখি, তা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে ধর্ষিত নারীর মৃতদেহ। কারণ দুনিয়ার সব শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এই কামনা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুঃসহ।
এযুগ ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকারের যুগ। এখানে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেকে যেমন আয়ের কথা চিন্তা করতে হবে, তেমনি মেয়েকেও। সুতরাং একটি সংসারে নারী-পুরুষ উভয়ী যদি উপার্জনক্ষম হন, তাহলে সংসার হয়ে উঠবে মধুময়।
বিবাহ নিয়ে আমাদের অভিভাবকদের মাঝে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তাঁরা ভাবেন যে, ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে অকর্মা হয়ে যাবে, পরিবারের হাল ধরবে না তারা ইত্যাদি। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা বলে অন্য কথা। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বিয়ে করেছিলেন ১৮ বছর বয়সে, অ্যারিস্টটল ১৭ বছর, শেক্সপিয়ার ১৬ বছরে। ভারতীয়দের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ে তাঁদেরকে সফলতা থেকে বঞ্চিত করেনি। পার্থক্য হল উনারা বিয়ে করে সফল হয়েছেন আর আমরা সফল হয়ে বিয়ে করতে চাই। ফলস্বরূপ যা হওয়ার তা হচ্ছে। কেননা, বাজে চিন্তা মাথায় নিয়ে কখনো সফল হওয়া যায় না।
বর্তমানে বিবাহের আরেকটি প্রধান অন্তরায় দেনমোহর। মেয়ের বাবারা ভাবেন, বিয়েতে দেনমোহর বেশি হওয়া মানেই মেয়ের সিকিউরিটি বেশি হওয়া। কিন্তু দেনমোহরই কি সব? একটু ভাবুন তো, যার হাতে আপনার মেয়েকে তুলে দিচ্ছেন তার মাথায় কেনো এত বোঝা চাপিয়ে দিবেন? আপনার মেয়েকেও তো উপার্জনক্ষম বানাতে পারেন। তাই বলছি মানসিকতার পরিবর্তন করুন, বিবাহ প্রথাকে সহজ করুন। কিন্তু সাথে সাখে যৌতুক প্রথার মতো সামাজিক ব্যাধিকেও উচ্চস্বরে না বলাও জরুরি।
ছেলে-মেয়ে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল হলে আপনারা পাশে থাকুন, বেড়ে উঠতে সাহায্য করুন। হলফ করে বলছি, শতভাগ না হোক অন্তত নব্বই ভাগই ধর্ষণ কমে যাবে সমাজে। এতে কোনো নারীকে কলঙ্কিত হতে হবে না, কাঁদতে হবে না কোনো পিতা-মাতাকে। ছোট্ট মেয়ে শিশুটির ছেলেবেলা রক্তে রঞ্জিত হবে না। সে বেড়ে উঠতে পারবে একটি ধর্ষকমুক্ত পরিবেশে। সর্বোপরি আপনাদের সন্তানগুলো যেন ধর্ষক না হয়, সে দিকেও লক্ষ রাখা জরুরি ।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ।
[email protected]
ঢাকা কলেজ/রায়হান/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম