বিলুপ্তির পথে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি
তামান্না শারমিন তিথি || রাইজিংবিডি.কম
বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাসের মূলে রয়েছে আমাদের সুপ্রাচীন এক সমৃদ্ধ নিজস্ব সংস্কৃতি। শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংগীত, খেলাধুলা, খাদ্যাভ্যাস, উৎসব-অনুষ্ঠান সব কিছু মিলেই হয় সংস্কৃতি, যা একটি জাতির জাতিগত পরিচয়।
বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস তো আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বাঙালি একদিন এই সাংস্কৃতিক অধিকার আদায় তথা ভাষার জন্য লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। পহেলা বৈশাখ পালনে বাঁধা দেওয়া, ধর্মের দোহাই দেখিয়ে বাংলা ভাষাকে আরবি হরফে লিখার মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে বিনাশের ষড়যন্ত্র, রবীন্দ্রসংগীত ও রচনাবলী নিষিদ্ধকরণসহ নানা সাংস্কৃতিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিল। আর এসব ক্ষেত্রে বাঙালি সর্বদা বীরত্বের সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তবে আজ কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই সংস্কৃতি? কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য?
বাংলা এবং বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। একসময় তার শ্রেষ্ঠত্বের মান ঠিকই ছিল, কিন্তু বর্তমানে কিছু সচেতন সমাজ বাদে প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা এক ভিন্ন চিত্র। কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের নববর্ষের গৌরব।
পহেলা বৈশাখ আসলেই মানুষ বাঙালি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। কৃত্রিমতার ছাঁচে নিজেকে বাঙালি সাজানোর ব্যাপক প্রচেষ্টা চলতে থাকে। কতিপয় কনসার্ট বা স্থানীয় ক্লাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে শোনা যায় ভিনদেশি ভাষার নাচ-গান ও বাদ্যযন্ত্রের তুমুল হট্টগোল। এমনকি অপসংস্কৃতির জোয়ারে আমারা এতটাই মাতোয়ারা যে, আমাদের নববর্ষের উৎসবে আজ ইভটিজিং ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনাও ঘটে।
বাংলার সংস্কৃতি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, জসীমউদ্দিনের সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ। আমাদের লোকসংগীত, বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি গান যেন বাঙালির অঙ্গে মাখা। অথচ এসব গানও আজ আমরা ভুলতে বসেছি। ইউসুফ-জুলেখা, লাইলি-মজনু, রাধা-কৃষ্ণের পালা দেখায় মগ্ন হয়ে চোখে জল চলে আসার দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। বরং সেই দৃশ্যটাই এখন গল্প হয়ে গেছে। বাঙালি এখন আধুনিকতার নামে বিদেশি সংস্কৃতি চর্চাতেই গভীর মনোযোগী।
বাংলার মানুষ স্বভাবতই একটু বেশি ভোজনপ্রিয়। আমাদের বলা হয় ভাতে-মাছে বাঙালি। ভাত, মাছ, সবজি, দুধ, দধি, ক্ষীর, শুঁটকি ছিল বাংলার জনপ্রিয় ও চির পরিচিত খাবার। গ্রামীণ এলাকায় দেখা যেত নানা মুখরোচক পিঠা তৈরির আয়োজন। আর শীতকালে তো বাড়ি বাড়ি পিঠাপুলির ধুম পড়ে যেত। কিন্তু আজ বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বদলে ফেলেছে নিজের রুচিবোধকেও। পরিবর্তন হয়ে গেছে আমাদের খাদ্যাভ্যাস। নিজস্ব খাবারগুলোর নাম ভুলে আমরা ভিড় জমাই ফাস্টফুড, ড্রিংকস, কোকাকোলা, চাইনিজ খাবারের দোকান বা রেস্টুরেন্টে। অথচ এসব খাবার শুধু আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকেই ভুলিয়ে দেয় না বরং সেসঙ্গে শরীরে নানা জটিলতাও তৈরি করতে পারে।
আমাদের সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলাগুলো। কানামাছি, গোল্লাছুট, কাবাডি, পুতুল খেলা, ষোলগুটি, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকা বাইচ, কড়ি, কুস্তি, চড়ুইভাতি এসব খেলাই ছিল বাঙালির বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলার ন্যূনতম পরিচয়ও নেই। চর্চার অভাবে এসব খেলা আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে হাজির। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে খেলাধুলা বলতেই বোঝায় কম্পিউটার গেমস আর বাচ্চাদের কাছে বিনোদন বলতেই বোঝায় কার্টুন ও আধুনিক ডিভাইস।
আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অতি পরিচিত প্রতীক গরুর গাড়ি, পালকি, ঢেঁকি, শীতলপাটি, খেজুর পাতার পাটি, হুক্কা, তাল পাতার পাখা, ধানের গোলা, বায়স্কোপসহ আরও অনেক কিছুর নাম পর্যন্ত অজানা আমাদের আজকের প্রজন্মের কাছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্বতা বলতে কিছুই থাকবে না।
দেশের উন্নয়নে আধুনিকায়নের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া তো কখনো কাম্য নয়। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় সজাগ হতে হবে এখনই। বিশ্বায়নের স্রোতে গা ভাসিয়ে হারিয়ে ফেলা যাবে না আমাদের নিজস্বতাকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বাঁচাতে হবে আমাদের চির পরিচিত বাঙালি সংস্কৃতিকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাবি/মাহি