ঢাকা     শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৭ ১৪৩১

বেকার সমস্যা সমাধানে কুটির শিল্প

কবিতা রাণী মৃধা, জবি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৫, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১  
বেকার সমস্যা সমাধানে কুটির শিল্প

কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য শিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এজন্য কুটির শিল্পের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এ শিল্পে বেশি দামি যন্ত্রপাতি ও বড় ধরনের মূলধন প্রয়োজন হয় না। অতি প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশের কুটির শিল্প লাভ করেছিল বিশ্ব খ্যাত মর্যাদা। বাঙালি শিল্পীদের হাতে তৈরি মসলিন সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। 

বাংলার দক্ষ কারিগর আপন হাতে তৈরি করত এমন আরও অনেক পণ্যসামগ্রী। সেদিন বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিজের জন্য বাইরের দিকে উন্মুখ হয়ে থাকতে হতো না। তাই কুটির শিল্পের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া সময়ের দাবি।

ঘরে বসে ভারী যন্ত্রপাতি ছাড়া হাতের সাহায্যে যেসব পণ্যসামগ্রী তৈরি বা উৎপাদন করা হয়, তাকে কুটির শিল্প বলে। হাতির দাঁতের ওপর শিল্পকর্মের খ্যাতি ছিল মুর্শিদাবাদের শিল্পীদের। মালদহ ও কাঞ্চন নগরের দা, ছুরি, বর্ধমানের বনপাশের বন্দুক, তরবারি, বর্ম এবং দিনাজপুরের জাতি, যশোরের চিরুনি, ঢাকার মসলিন ইত্যাদির খ্যাতি ছিল বেশ। কুটির শিল্পে নানা শ্রেণির লোক কাজ করে থাকে। যেমন- কামার, কুমার, তাঁতি, কাঁসারি, শাখারি, স্বর্ণকার প্রভৃতি। কুটির শিল্পের নানা উপকরণ রয়েছে আমাদের দেশে। তার মধ্যে তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, শঙ্খশিল্প, রেশমশিল্প, স্বর্ণশিল্প সূচিশিল্প, রন্ধনশিল্প, শীতলপাটি, পাটের ব্যাগ, হাত পাখা, মাছ ধরার জাল, কাঠের আসবাবপত্র ইত্যাদি প্রধান। যুগ যুগ ধরে এগুলো আমাদের কুটির শিল্প হিসেবে পরিচিত।

আরো পড়ুন:

কুটির শিল্পের সেই গৌরবোজ্বল দিনগুলো আজ আর নেই। অষ্টাদশ শতক থেকে ইউরোপে যে শিল্পবিপ্লব দেখা দিয়েছিল উনিশ শতকের মধ্যভাগে তা এ দেশের কুটির শিল্পকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। তবুও কুটির শিল্প টিকে আছে আমাদের দেশে এবং ভবিষ্যতেও এর চাহিদা থাকবে বলে আশা করা যায়।

এসব পণ্যসামগ্রীকে শিল্পীরা সহজেই বিভিন্ন আকৃতি প্রদানপূর্বক গঠনশৈলীতে বৈচিত্র্য আনয়ন করতে পারে। এক সময় বাংলার গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা ছিল কুটির শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ একদল মানুষ, বিশেষ একটি শিল্পে দক্ষ হয়ে উঠতেন পুরুষানুক্রমে। ফলে কর্ম অনুসারে গড়ে উঠেছিল একেকটি বর্ণবিভাগ। সভ্যতার আদিকাল থেকে সব শিল্পের সূচনা হয়েছিল কুটিরে কুটিরে। এগুলো আমাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিল।

কুটির শিল্পের কতগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রুচি ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কুটির শিল্প তুলনাহীন। এ শিল্প নানা প্রকার কারুকার্যখচিত দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে পারে। কুটির শিল্প কারিগরদের পরিবারস্থ লোকদের কাজে নিয়োগের সুযোগ দিয়ে থাকে। অধিকন্তু কয়েকটি নির্দিষ্ট শিল্প রয়েছে। যেমন-পাটের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি, বিড়ি তৈরি, বোতাম তৈরি করা, হস্তচালিত তাঁতের সূতিবস্ত্র তৈরি, শঙ্খশিল্প, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল তৈরি, শীতল পাটি তৈরি, বাঁশ-বেতের চেয়ার, টেবিল তৈরি ইত্যাদি; যা বৃহদায়তন শিল্পে বহুল পরিমাণে উৎপাদনের সুবিধা নেই। 

অনেক কুটির শিল্প বৃহৎ কারখানা শিল্পের উৎপাদনের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে কুটির শিল্প দ্বারা গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের জন্য সরবরাহ এবং পরিপূরক আয়ে যথেষ্ট সুবিধা আছে। কারণ তারা গ্রাম ছেড়ে সারা বছরের জন্য শহরে গিয়ে কোনো কারখানায় কাজ গ্রহণ করতে পারে না। এদিকে কুটির শিল্পের অভাবে বহু কৃষককে বছরের কয়েকটি মাস বিনা কাজে অলস সময় কাটাতে হয়, এ সুযোগ এবং সুবিধার কারণেই বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠা দ্বারা কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করতে পারা যাবে না। তাই দেখা যায়, শত অসুবিধা থাকার পরও কিছু কিছু কটির শিল্প আজও পুরাতন ঐতিহ্য বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে এবং চলবে।

আমাদের দেশে বেকার সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করেছে। এ সমস্যার সমাধান করা যায় কুটির শিল্পের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিতে সফল জাপানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। জাপানের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলতে গেলে কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র যন্ত্রশিল্প। শতকরা ৮৫ জন জাপানি শ্রমিক কুটির ও ক্ষুদ্রশিল্পে নিযুক্ত। প্রায় প্রতিটি জাপানি পরিবারে প্রত্যেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রের সাহায্যে শিল্পদ্রব্য তৈরি করে থাকে। সরকার থেকে তা ন্যায্য মূল্যে কিনে নেওয়া হয়। এসব শিল্প তৈরিতে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা সমাধান হয়েছে, তেমনি তা বিদেশে রপ্তানি করে নিজেদের দেশ হয়েছে উন্নত। সরকারি সহযোগিতায় কুটির শিল্পের প্রসার ঘটলে আমাদের বেকার সমস্যাও অনেকাংশে কমে আসতে পারে।

বাংলাদেশে কুটির শিল্পের অবনতির পেছনে নানা কারণ বিদ্যমান। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব শুরু হয় বৃহৎ শিল্প আবিষ্কারের পর। ভারতবর্ষে তথা বাংলাদেশে মুসলমান যুগ পার হয়ে যেদিন ইংরেজ বণিকরা জাহাজ ভর্তি ম্যাঞ্চেস্টারের মিলের সস্তা কাপড় আর গ্লাসগো, বাকিংহামের কারখানায় তৈরি লোহার দ্রব্যসম্ভার এদেশে আগমন করল, সেদিন থেকে শুরু হলো বাংলার কুটির শিল্পের পতন। জাত ব্যবসা ত্যাগ করে কুটিরশিল্পীরা অনেকেই ক্ষেতমজুর হয় এবং কেউ কেউ যোগ দেয় কারখানায় শ্রমিক হিসেবে। 

তাছাড়া বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা’ নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকার পরও কুটির শিল্পে নিয়োজিত লোকেরা তেমন কোনো সহজ সুবিধা পাচ্ছে না। তাদের উৎপাদিত পণ্যের খরচ হয়ে যাচ্ছে বেশি। এই সুযোগে অল্প মূল্যের বিদেশি পণ্য এসে বাজার দখল করে নিয়েছে। মূল্য কম হলেও সেগুলোর বাইরের চাকচিক্য জনগণকে আকৃষ্ট করছে বেশি। ফলে কুটির শিল্পীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ক্রেতারাও অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের দ্রব্যসামগ্রী কিনতে আগ্রহী। এসব কারণে আমাদের কুটির শিল্প দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

কুটির শিল্পকে বাঁচাতে হলে গ্রাম্যশিল্পকে যোগাতে হবে মূলধন, সরবরাহ করতে হবে সস্তায় কাঁচামাল। সরকারি তরফ থেকে উৎসাহ দান ছাড়া কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। এর জন্য যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে-

১. কুটির শিল্পে নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথাসম্ভব সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিতে হবে।

২. দেশের প্রত্যেকটি গ্রামে সমবায় ভিত্তিক কুটির শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

৩. কুটিরশিল্পীদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. দেশের নারী সমাজকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কুটির শিল্পের নানা কাজে নিযুক্ত করতে হবে।

৫. আমাদের কুটির শিল্পে যে সমস্ত পণ্য বেশি তৈরি হবে, বিদেশ থেকে সে জাতীয় পণ্য অবাধ আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।

৬. নিপুণ কুটিরশিল্পীদের মানপত্র, বৃত্তি এবং পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে।

কুটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্য, এর পুনরুজ্জীবন ছাড়া এদেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণ সম্ভব নয়। এদেশের কুটির শিল্পের খ্যাতি একদিন ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপেও সমাদৃত হয়েছিল। চীনের সম্রাট, বাগদাদের খলিফা, রোমের শাসক বাংলার কুটির শিল্পের সমাদর করতেন। দিল্লির বাদশাহ ও বাংলার নবাবরা ছিলেন মসলিনের সমঝদার। ঐতিহাসিক পিননীর বিবরণ থেকে জানা যায়, রোম নগরীর অভিজাত সুন্দরীরা মসলিন পরিধান করতেন। এতে কুটির শিল্পী ও তাদের উৎপাদিত শিল্পের মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে কৃষকদের অবসরকালীন কর্মসংস্থান ও অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ হিসেবে কুটির শিল্পের গুরুত্ব কম নয়। নারীরা অধিক সংখ্যায় কুটির শিল্পে কাজ করতে পারেন। এতে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও কুটির শিল্প অবহেলিত হয়নি। জাপান যে স্বল্পমূল্যের পণ্য সরবরাহ করে বিশ্বের বাজার দখল করে রেখেছে, তার মূলে কুটির শিল্পের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

কুটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এই শিল্পের সাথে আমাদের অর্থনীতির উন্নতি অবনতি জড়িত। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ হলো কুটির শিল্প। এর মাধ্যমে যেমন বেকার সমস্যা কমিয়ে আনা যায়, তেমনি দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। এসব দিক চিন্তা করে কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও প্রসার ঘটানো প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

/মাহি/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়