ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১৪ ১৪৩১

ভোক্তা অধিকার নিয়ে যা বলছেন তরুণরা

মো. আবু তারেক, চবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১  
ভোক্তা অধিকার নিয়ে যা বলছেন তরুণরা

মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম। যদিও দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বেশকিছু আইন রয়েছে কিন্তু নিজেদের অধিকার ও আইন সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার করতে হবে, পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে আইনটি অন্তর্ভুক্ত করে এর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। 

ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে পণ্য বা সেবা ক্রয়ে দূরদর্শিতা প্রয়োগ করতে হবে এবং কোনোভাবে প্রতারণার সম্মুখীন হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত কিংবা সরাসরি ফোনের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে হবে। ভোক্তা ও সচেতন নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দেশ থেকে দুর্নীতি হঠানো সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আবু তারেক।

ভোক্তা অধিকারের অজ্ঞতাই প্রতারণার হাতিয়ার

আরো পড়ুন:

রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘ভোক্তা অধিকার’। কিন্তু ভোক্তার অধিকার কী, প্রতারিত হলে কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, তা জানেনই না ভোক্তা নিজে। সময়ে অসময়ে আমাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি দেশের খুচরা বাজারগুলোতে। আবার কখনো কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য কিনেও বিড়ম্বিত হই, পণ্য ফেরতে জড়াতে হয় অনেক বাক-বিতর্কে। নিরাপদ এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারাটা ভোক্তার অধিকার এবং তা আইন দ্বারা সংরক্ষিত। বিক্রেতারা যাতে কোনোভাবেই ক্রেতাদের ধোঁকা দিতে বা ঠকাতে না পারেন, সে লক্ষ্যেই ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে সংসদ কর্তৃক গৃহীত ‘ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ ২০০৯’ আইনটি ২০০৯ সালের ৫ এপ্রিল অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে এটুকু সত্য যে, আইনটি প্রণয়নের ফলে জনগণ এর সুফল কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প-বিস্তর হলেও পেয়েছে। পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠানও আগের থেকে অনেক সতর্ক হয়েছে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ যতটা হওয়ার কথা, ঠিক ততটা চোখে পড়ে না। এর মূলে রয়েছে আইনটি সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা। 

অশিক্ষিত থেকে শুরু করে শিক্ষিত শ্রেণিও ‘ভোক্তা অধিকার আইন’ সম্পর্কে তেমনভাবে অবগত নন। সরকারের পক্ষেও এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ফলে এই আইনের সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ক্রেতারাও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোক্তা আইন এতটা সক্রিয় যেখানে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করা কল্পনাতীত। এই আইনে ভেজাল বা প্রতারণা করলে লাইসেন্স বাতিলসহ ফৌজদারি আইনে দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখার পাশাপাশি এই আইন লঙ্ঘনে অর্থ জরিমানা ও কারাদণ্ডসহ উভয় দণ্ডের বিধানও রয়েছে। তাই আইনের সুফল ভোগ করার জন্য নাগরিককেই সচেতন হতে হয়, তা না হলে অসাধু শ্রেণি অন্যায়ভাবে সুবিধা নেবে এটাই স্বাভাবিক। 

শুধু আইন এবং অধিদপ্তর নয়, সরকারি এবং বেসরকারিভাবে শহরগুলোতে প্রতিনিয়ত করতে হবে সচেতনতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাম্পেইনিং। সেইসঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে আয়োজন করতে হবে প্রচারণা কিংবা পথনাট্য, যাতে করে প্রতিটি নাগরিক একজন ভোক্তা হিসেবে এই মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। কাজেই ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতকরণে আইন প্রয়োগ, প্রশাসন ও নাগরিককে একই মাত্রায় কাজ করতে হবে।

মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ

আইনের প্রয়োগে নিশ্চিত হোক ভোক্তার সর্বোচ্চ অধিকার

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জনবান্ধন ও কল্যাণকর আইনগুলোর অন্যতম একটি। সর্বপ্রথম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয় ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল এবং এই আইনের ১৮ ও ৫ ধারা অনুযায়ী যথাক্রমে ২০০৯ সালের ৮ জুন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং ২০০৯ এর ২৪ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ গঠন করা হয়। জনসাধারণের নিত্যপ্রয়োজনে ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের গুণগত মান এবং সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে এই আইনের ব্যবহার বর্তমান সময়ে ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর পণ্য ক্রয়ের ব্যাপারে নতুন করে জনমানুষের মনে আশার সঞ্চার সৃষ্টি করেছে। 

দিনকে দিন বাড়ছে ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় প্রতিকার চেয়ে সুফল পাওয়া মানুষের সংখ্যাও। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় করা অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয় মাত্র সাত দিনেই। এক্ষেত্রে জরিমানাকৃত অর্থের ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয় অভিযোগকারীকে। এই আইনের আওতায় আইন ভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সর্বোচ্চ অনূর্ধ্ব তিন বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার সক্ষমতা রাখে। ভোক্তার স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য ও পণ্য নিশ্চিত করণে জনসাধারণকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। ভোক্তার জন্য নিরাপদ খাবার ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে গ্রহণ করতে হবে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। কেবল আইনই নয়, আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভোক্তার সর্বোচ্চ অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।

মো. রাফসান, শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স

ভোক্তা অধিকার রক্ষায় আইন জানা জরুরি

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা ধরনের দ্রব্য ও সেবা গ্রহণ করে থাকি। প্রযুক্তির উন্নয়নে যেভাবে পণ্য ও সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক তার কয়েকগুণ ভেজাল পণ্য এবং প্রতারণার হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে অন্য একটি মাত্রা যোগ হয়েছে অনলাইন ব্যবসা এবং সেবা। বর্তমান বাজারের প্রায় প্রত্যেকটা পণ্য কোনো না কোনোভাবে ভেজাল মিশ্রিত। চাল, ডাল, মাছ, ফল এবং তরি-তরকারি থেকে শুরু করে কোনো কিছুই যেন নিরাপদ নয়। ওজনে কারচুপি করা, মেয়াদোত্তীর্ণ দ্রব্য বিক্রি করা, অধিক দাম নির্ধারণ এবং প্রতারণাসহ যাবতীয় সমস্যায় ভোক্তারা জর্জরিত।  নিরাপদ খাবার এবং সুস্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার, কিন্তু আজ এ সমস্ত বিষয়গুলো যেন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ২০০৯ সালে ‘ভোক্তা অধিকার আইন’ ও ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন পাশ করা হয়েছে। এসব আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও ভোক্তাদের অধিকার রক্ষা এবং এর লঙ্ঘনে নানা ধরনের শাস্তি ও জরিমানার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু সমস্যা হলো এসব আইনের বিষয়ে দেশের বেশিরভাগ ভোক্তাই কিছুই জানে না। 

দৈনন্দিন যতজন মানুষের ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন হয়, তার সিকিভাগও আইনের আওতায় আসে না। এভাবে করেই অসাধু ব্যবসায়ীরা এবং প্রতারকরা দিন দিন ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মানুষ যতদিন আইনের উপর আস্থাশীল এবং শ্রদ্ধাশীল হতে পারবে না, ততদিন নিজের কার্যকর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হবে না। তাই আইন জানা সর্বাগ্রে জরুরি। কোনো ভোক্তা (ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯) আইনের যে কোনো ধারায় ভুক্তভোগী হলে এই আইনের ৭৬(১) ধারায় নিকটস্থ মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।  অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী ধার্যকৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ পাওয়ার বিধান রয়েছে।

ইস্রাফিল রনি, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই

করোনাকালীন সময়ে বর্তমানে আমাদের দেশে অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার হার অনেকাংশে বেড়েছে। তবে, সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকায় ই-কমার্সের মাধ্যমে বেচাকেনায় ক্রেতারা প্রতারণার স্বীকার হচ্ছে। প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করা, সঠিক মূল্য তালিকা প্রকাশ না করা, ভেজাল জিনিস বিক্রি করা, অধিক মূল্য নির্ধারণ করা, সঠিক পরিমাপের ব্যাপারে অবহেলা করা নিত্য দিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ক্রেতারা জানেন না কোথায় বা কিভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ব্যবস্থা নিলে আদৌ কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে কিনা। আইনে এ ধরনের কাজের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা বলা আছে। তন্মধ্যে ভোক্তা অধিকার আইন, ২০০৯ উল্লেখযোগ্য। তবে এই আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকার দরুণ একজন ভোক্তার প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এসব আইনের গ্রহণযোগ্যতা তখনই বৃদ্ধি পাবে, যখন এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। সঠিক দাম, মাপ ও মানের পণ্য পাওয়া একজন ভোক্তার অধিকার। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত অনলাইনে একজন ভোক্তা যেন সহজেই তার অভিযোগ দায়ের করতে পারে, এমন ব্যবস্থা করা।

জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

আইনের যথাযথ প্রয়োগই ভোক্তা অধিকারের নিশ্চায়ক

নাগরিকদের সুচারুরূপে জীবন ধারণের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদানকৃত নাগরিক অধিকারের মধ্য ভোক্তা অধিকার অন্যতম। ভোক্তা অধিকার বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমালোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভোক্তা অধিকার হলো অর্থের বিনিময়ে মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য ও সেবা লাভের অধিকার। ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’ প্রণীত হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে সেই আইন সম্পর্কে সাধারণ নাগরিক ওয়াকিবহাল নন। 

ভোক্তা অধিকার বলতে যে একটা বিষয় আছে, তা যেন নাগরিকদের জানাশোনার বাইরে। ফলে প্রতিনিয়ত ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারণা যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এছাড়াও খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যে ভেজাল থাকবে এটি যেন আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। সেইসঙ্গে ওজন ও মানের তো কোনো বালাই নেই। পয়সা গুণেও মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া সে তো আমাদের দুর্লভ বিষয়। তাই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে প্রয়োজন প্রণীত আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। তবে রাষ্ট্রের একার পক্ষে এ অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতাই নিশ্চিত করতে পারে নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার।

তৌহিদা আকতার, শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

সৌদিপ/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়