ভাসমান নৌকায় প্রযুক্তি শিখছে শিশুরা
এম এম আরিফুল ইসলাম, নাটোর || রাইজিংবিডি.কম
নৌকায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিনোদনসহ সব ধরনের শিক্ষা পাচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। বর্ষা ও বন্যা ছাড়াও ১২ মাস শিশুরা এই সুবিধাটা পায়।
নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় নন্দকুজা, আত্রাই নদীর তীরবর্তী এলাকায় ৮টি নৌকায় স্কুল চালু আছে। এর মধ্যে বিলদহর ও কলম এলাকায় নৌকায় কম্পিউটার শিক্ষা চালু আছে। কম্পিউটার, দর্জি, কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫০০ নারী, কিশোরী এবং শিক্ষার্থী নিয়েছেন। নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ জেলায়ও চালু আছে। নাটোরের সিংড়ায়, গুরুদাসপুর ও নাটোর সদর হালসা এলাকা ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর উপজেলায় নৌকা স্কুল আছে। চলনবিলের এই মডেল আরও ৮টি দেশ গ্রহণ করেছে।
২০০২ সাল থেকে নৌকা স্কুল কার্যক্রম শুরু হয়। এখন বিশ্বের মডেল। নৌকা স্কুল শুরুর পর তরুণ স্থপতি রেজোয়ান নৌকা স্কুলের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে লাইব্রেরি, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, ইন্টারনেট ও সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে আসেন। তার প্রতিষ্ঠান ‘সিধুলাই স্ব-নির্ভর সংস্থা’ জাতিসংঘ পরিবেশ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করায় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে।
কম্পিউটার প্রশিক্ষক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালীন সময় ১০ জন করে ৪টা ল্যাপটপে ট্রেনিং দেওয়া হয়। সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত পাঠাগারে বই পড়ানো এবং কম্পিউটার ট্রেনিং দেওয়া হয়। ১৩ বছর ধরে আমি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’
বিলদহর পশ্চিম পাড়ার হুসনে আরা, তানজিলা এখানে শিখতে এসেছে। বিলদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন কম্পিউটার শিখে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। কম্পিউটারে দক্ষ হয়ে দেশের কল্যাণে ব্যয় করতে চান।
প্রোগ্রাম ম্যানেজার মধুসূদন কর্মকার বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীরা লাইব্রেরির নৌকাতে যান, যেখানে তারা বই পড়েন আর কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। সংস্থা বন্যাপ্রবণ এলাকাতে নৌকায় প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিচালনা করছে। প্রতিবছর ১৩,৫০০ জন সুবিধাবঞ্চিত কিশোরী ও নারী এই প্রশিক্ষণ সুবিধা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও প্রশিক্ষণ নৌকা থেকে নদীর পাড়ে জলবায়ু পরিবর্তনে মানানসই জীবন যাত্রার উপর সান্ধ্যকালীন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।’
সংস্থার সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সুপ্রকাশ পাল বলেন, ‘বর্তমানে ২৬টি নৌকার স্কুলে প্রতিদিন তিন শিফটে ২,৩৪০ জন ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে। প্রতিটি নৌকা একবারে ৩০ জন ছাত্রছাত্রী ধারণ করতে পারে। প্রতিদিন সকালে নৌকা স্কুলগুলো বিভিন্ন গ্রামে যায় এবং শিশুদের বাড়ির সামনে থেকে নৌকায় তুলে নেয়। তারপর নৌকাটি একটি জায়গায় দাঁড়ায় এবং শিশুদের শিক্ষা দেয়।’
স্কুলগুলোতে একটি ল্যাপটপ, কয়েকশত বই থাকে এবং সোলার প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের মাধ্যমে নৌকার ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলো চালানো হয়। স্কুলে যাওয়া শিশুরা ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী। ২০০২ থেকে ২০২১ সাল, এই সময়কালে সিধুলাই নৌকাস্কুলে ২১,২৯০ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সুবিধা পেয়েছে।
নতুন শিক্ষামূলক প্লে-বোটে (খেলা-নৌকা) ছাত্র-ছাত্রীরা খেলাধুলা করতে পারে। ২০১৭ সালে রেজোয়ান নৌকা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা করার জন্য খেলা-নৌকা ডিজাইন করেছিলেন। এই নৌকায় খেলাধুলা করার জন্য শিক্ষামূলক খেলার উপকরণ আছে। এর মধ্যে ডাবল সুয়িং, অ্যালফাবেট ও নিউমারেসি মার্কিংস্, অ্যালফাবেট ও নিউমারেসি ওয়াল প্যানেল, মাঙ্কি বার, স্লাইডসহ শিশুদের জন্য প্রায় ৫০০ বই আছে। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগযুক্ত চারটি ল্যাপটপের সাহায্যে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ভিডিও শিশুদের দেখানো হয়।
জানা যায়, ২০০২ সালে রেজোয়ান নিজেদের অর্থায়নে একটা ডিজাইনকৃত নৌকা তৈরি করতে সক্ষম হন এবং ভাসমান স্কুল কার্যক্রম চালু করেন। ২০০৫ সালে তরুণ স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ান একটি অবিশ্বাস্য সুসংবাদ পেলেন। তার দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন বড় আকারে সম্প্রসারণের জন্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন তাকে সহযোগিতা করবে। গেটস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা তার এই ছোট প্রতিষ্ঠানটির কর্মপরিধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। নৌকার কলেবর বৃদ্ধি পায়, সমস্ত নৌকায় সৌর বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেটসহ কম্পিউটার আনা হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটিতে ৫০,০০০ বই ও ১০০টিরও বেশি কম্পিউটার আনা হয়। এভাবেই শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা।
/মাহি/