ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

সাত কলেজে পদে পদে ভোগান্তি, ঢাবির উদ্যোগ কত দূর

মো. মমিনুল হক খান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:০৮, ১ অক্টোবর ২০২৩  
সাত কলেজে পদে পদে ভোগান্তি, ঢাবির উদ্যোগ কত দূর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির ছয় বছর পার করছে সাত কলেজ। দীর্ঘ এই সময়ের পরও প্রশ্ন উঠছে সাত কলেজের মান নিয়ে। প্রতি বছর ফল প্রকাশের পরেই বিভিন্ন দাবি নিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিতে দেখা যায় সাত কলেজে শিক্ষার্থীদের। মূলত এসময়ে প্রমোশন না পাওয়া শিক্ষার্থীরাই সড়ক অবরোধের মতো নানা কর্মসূচি ঘোষণা করে।

এসব কর্মসূচির কারণে নীলক্ষেত মোড়ে তীব্র যানজট ও জনগণের ভোগান্তি তৈরি হয়। এসময়ে সাত কলেজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন সাধারণ জনগণ থেকে দেশে শিক্ষাবিদরা। একেই সাথে অধিভুক্তি বাতিলের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ তৈরি হয়। 

দাবি আদায়ের প্রাক্কালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিয়মকানুন স্মরণ করিয়ে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু দাবি আদায়ের আন্দোলনের তীব্রতা এতটুকু বেশি হয় যে, নিয়ম স্থগিত করে দাবি মেনে নিয়ে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে। 

গত আগস্ট মাসে আন্দোলনের তীব্রতায় সাত কলেজের জন্য আলাদা নিয়ম অর্থাৎ সিজিপিএ শর্ত কমিয়ে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এতে করে প্রমোশন না পাওয়া শিক্ষার্থীদের উপকারে আসলেও বাস্তবিক অর্থে সাত কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত হবে।  

সিজিপিএ শর্ত শিথিল ও শিক্ষার মান উন্নয়নে বাধা

গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ ২০২১ এবং অনার্স তৃতীয় বর্ষ ২০২১ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যে শিক্ষার্থীরা সিজিপিএ ২.০০ পেয়েছেন, তাদের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে উন্নীত করা হয়েছে।  

কিন্তু স্নাতকের সার্টিফিকেট অর্জন করতে ২.৫০ সিজিপিএ পেতে হবে। যে শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত ২.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হবে তারা ফাইনাল ইয়ারে ২.৫০ পূর্ণ অনেকেই করতে পারবে না। সে জায়গায় তাকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। 

সিজপিএ শর্ত শিথিলে অল্পতেই প্রমোশন পাওয়ার আশায় গা ভাসাবে না পড়াশোনায়- এমনটিই মনে করছে শিক্ষার্থীরা। অধিভুক্তি হওয়ার আগে অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে এই শর্ত ছিল। সেই হিসেবে আগের নিয়মে ফেরায় শিক্ষার্থীরা বলছে, উন্নতি নয় অবনতির পথেই হাঁটছে সাত কলেজ। 

৬ বছরেও কেন ফলাফল বিপর্যয়?  

অধিভুক্তির ছয় বছর পেরিয়ে গেছে সাত কলেজ। তবুও ফলাফল বিপর্যায়ের বৃত্ততেই আটকা রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি হওয়া রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজ। 

একজন শিশু জন্মের ৫ বছর পরেই স্কুলে ভর্তি করা হয়ে থাকে। এ সময়ে শিশুটি কথা বলতে ও হাঁটতে পারে। আর ৬ বছর বয়স পড়লেই লেটার মার্ক পেয়েই উত্তীর্ণ হয় শিশুটি- এটি কোনও উপমিত বাক্য কিংবা কাল্পনিক নয়। তবুও কেন ৬ বছর বয়সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে পারছে না সাত কলেজ- এ প্রশ্নটি সবার মাঝেই। 

ইংরেজি, দর্শন, রসায়ন, পদার্থ ও হিসাববিজ্ঞানসহ আরও বেশকিছু বিভাগের ফলাফল প্রতিবছরেই বিপর্যয় ঘটে। কিন্তু এসব বিষয়ের ফলাফল উন্নতিতে সাত কলেজ মনোযোগী হলে নীলক্ষেত মোড়ে অবরোধের চিত্র মিডিয়ায় দেখা যেত না বলে মনে করে শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষক সংকট

সাত কলেজে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন এক হাজার ২২৭ জন। অর্থাৎ ১২২ জন শিক্ষার্থীদের বিপরীতে ১ জন করে শিক্ষক রয়েছেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বর্তমানে গড়ে ১৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২ হাজারের বেশি শিক্ষক আছেন। মূলত এখানেই আকাশ-পাতাল তফাৎ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে সাত কলেজের একাডেমিক শিক্ষা ও ফলাফল বিপর্যয়ে। 

শিক্ষক সংকট কাটাতে অধ্যক্ষদের উদ্যোগ ‘মৃত’

শিক্ষক সংকট কাটাতে ৫ নভেম্বর ২০১৯ সালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির সঙ্গে সাত কলেজের অধ্যক্ষরা বৈঠক করেন। এসময়ে প্রতিটি বিভাগে কমপক্ষে ১৬ জন করে শিক্ষক নিয়োগ, কলেজের বৈজ্ঞানিক ও কম্পিউটার ল্যাব আধুনিক করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, কমপক্ষে পাঁচটি করে বাস দেওয়া, ক্যাম্পাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ আরও কয়েকটি দাবি জানিয়েছিল অধ্যক্ষরা। পদ সৃষ্টিতে সময় লাগায় আপাতত সংযুক্তির মাধ্যমে হলেও শিক্ষক দেওয়ার অনুরোধ করেছিল ওই সময়ের অধ্যক্ষরা। চার বছর হতে চললেও এসব বাস্তবায়নের নজির দেখা যাচ্ছে না।  

তিন কলেজের আয়তন ছোট, নেই অবকাঠামোর সুযোগ

সাত কলেজের মধ্যে আয়তনে সবচেয় বড় ২৫ একরের বাঙলা কলেজ। এরপরেই রয়েছে ১৮ একর করে ইডেন মহিলা কলেজ ও ঢাকা কলেজের। এছাড়াও তিতুমীর কলেজের আয়তন প্রায় ১২ একর। অবকাঠামো করার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে এ কলেজগুলোর।

অপরদিকে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ আয়তন মাত্র ২-৪ একর করে। অবকাঠামো করার একদমেই সুযোগ নেই। ৩-৪ তলা বিশিষ্ট দুই-তিনটি একাডেমিক ভবন রয়েছে। কিন্তু প্রায় ১৮-২০টি বিভাগের অনার্স-মাস্টার্স কোর্স রয়েছে। 

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ১৮টি বিষয়ে স্নাতক পড়ানো হয়। কিন্তু এ কলেজটিতে রয়েছে মাত্র তিনটি একাডেমিক ভবন। এরমধ্যে প্রশাসনিক ভবনও অন্তর্ভুক্ত। একটি ক্লাস রুমে একাধিক বিভাগ রয়েছে। তার সাথে রয়েছে প্রকট আকারে শিক্ষক সংকট। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ কত দূর

গত বছরের আগস্টে সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওই সময় কলেজগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে সাত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের বৈঠকের পর এটি চূড়ান্ত হওয়ার কথাও ছিল। তবে বছর পেরিয়ে গেলেও বৈঠকটির ব্যাপারে গণমাধ্যমে কোনও কিছুই প্রকাশিত হয়নি। 

ঢাবির মানে যেতে না পারায় বাড়ছে সাত কলেজে ফেল

সাত কলেজে শিক্ষক সংকটের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষক নেই। আর এ কারণেই কোনোক্রমেই কলেজগুলোর ফেল করা শিক্ষার্থী কমানো যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানে সেমিস্টার পদ্ধতি সেখানে সাত কলেজের ইয়ারভিত্তিক। সেটি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের জন্য সাংঘর্ষিক। 

সাত কলেজের মান বাড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো নিয়মকানুন প্রয়োগ ও নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেই মনে করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। 

বাংলা মাধ্যমে সাত কলেজের বেশিরভাগ বিভাগেই পাঠদান ও মূল্যায়ন করা হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখানেই বিপরীত। বাংলা মাধ্যমে পাঠদানের কারণে  সাত কলেজের একজন গ্র্যাজুয়েট ইংরেজি ভাষায় নড়বড়ে থাকে। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমেই পাঠদান ও মূল্যায়ন হয়ে থাকে। এসব কারণেই চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।   

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি বাঙলা কলেজ

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়