ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রাবিতে দেশের সংবিধান বিষয়ক একমাত্র শহিদ মিনার

আল মাহমুদ বিজয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৯, ৪ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৪:৪২, ৪ নভেম্বর ২০২৩
রাবিতে দেশের সংবিধান বিষয়ক একমাত্র শহিদ মিনার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের(রাবি) শহিদ মিনারই দেশের সংবিধান বিষয়ক একমাত্র শহিদ মিনার। সংবিধানকে বলা হয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের চারটি মূলনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অনন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ হল বিশ্ববিদ্যালয়টির শহীদ মিনার।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি 'খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠনে এক মাস পর ৯ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলী রাবির শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।

এ মিনারে রয়েছে চারটি স্তম্ভ— যা উল্লম্বভাবে উঠে গেছে উপরের দিকে। স্তম্ভ চারটি উপরের দিকে বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ। যা ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্দেশ করে।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই। যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ আজ আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে আলাদা একটি চত্বর। যার পরতে পরতে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। ম্যুরাল চিত্র, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, উন্মুক্ত মঞ্চ, সুবিস্তৃত খোলা প্রান্তর ও ফুলের বাগান। এসব কিছুর সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে রাবির শহীদ মিনার চত্বর।

শহীদ মিনারটি কৃত্রিমভাবে তৈরি মাটির টিলার উপর অবস্থিত। মূল স্তম্ভটির নকশা কে করেছেন তা দীর্ঘদিন অজানাই ছিল। রাবির চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষক ড. বনি আদম তাঁর পিএইচডি গবেষণায় এ শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভের নকশাকার হিসেবে স্থপতি খায়রুল এনামের কথা উল্লেখ করেন।

এ প্রসঙ্গে ড. বনি আদম বলেন, ‘গবেষণার কাজে তথ্যটি আমার খুব প্রয়োজন ছিল। আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন পর্যন্ত মূল স্তম্ভটি কে নকশা করেছেন সে বিষয়ে অনলাইন কিংবা অন্য কোনো সোর্সে খুঁজে পাইনি। পরবর্তীতে স্থপতি রবিউল হুসাইন রচিত ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি’ বইয়ে রাবির শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে খায়রুল এনামের নামটি দেখতে পাই।’

পরবর্তীতে জানা যায় রাবির শহীদ মিনারের প্রথম নকশাটি করেছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি অধ্যাপক খায়রুল এনাম। অধ্যাপক এনাম বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। এর আগে, তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বুয়েটের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যও ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে স্থাপত্য ইনস্টিটিউটে আজীবন সম্মাননা পান অধ্যাপক খায়রুল এনাম।

রাবিতে নির্মিত শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভটির বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক খায়রুল এনাম বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের প্রথম ডিজাইনটি আমি করেছিলাম। চারটি মূলনীতিকে ফোকাস করেই এই ডিজাইনটি করা হয়েছিল। তবে কাজটি আমি শেষ করতে পারিনি; মূল নকশাটিকে ঠিক রেখে কিছুটা পরিবর্তন করে আরেকজন আর্কিটেক্ট এর নির্মাণ কাজটি শেষ করেছিলেন।’

সংবিধানের চার মূলনীতিকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে অধ্যাপক এনাম বলেন, ‘স্বাধীনতা থেকে আরম্ভ করে আমাদের ত্যাগ, দেশের উন্নয়ন এবং বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের নেতৃত্ব—এই বিষয়গুলো আমাদের মাথায় ছিল। দেশের সংবিধান প্রণয়ণের কাজটিও তখন চলছিল এবং সেখানে চারটি মূলনীতির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই চারটি মূলনীতিকে থিম ধরে এই শহীদ মিনারের ডিজাইনটি দেওয়া হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই শহীদ মিনারকে স্বাধীনতার পর নির্মিত দেশের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে মনে করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নাইম হক বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের সাংবিধানিক আদর্শের মূল চারটি নীতি শহীদ মিনারে চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেছে। চারটি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা সংযুক্ত ফলকের সমন্বয়ে তৈরি স্থাপনাটিকে আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতির এক অভূতপূর্ব প্রতিবিম্ব বলা চলে।’

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়ালিউল মুহাম্মদ তূর্য জানান, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সাংবিধানিকভাবে চারটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই চারটি মূল স্তম্ভকে প্রতিফলিত করেই এই শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছে। ব্যতিক্রমী এই শহীদ মিনারটি গোটা দেশকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে থাকে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি জিনিসেরই একটি কাঠামো থাকে। একটি বিল্ডিং যেমন কয়েকটি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে; তদ্রুপ আমাদের সংবিধানের চারটি পিলার বা চারটি মূলনীতি রয়েছে। রাবির শহীদ মিনারের চারটি পিলার ঠিক তেমনিভাবে আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতিকে প্রতিফলিত করছে।’

/মেহেদী/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়